দক্ষিণের কড়চা

ইংরেজ পণ্ডিতেরা যতই নবদ্বীপকে অক্সফোর্ডের সঙ্গে একাসনে বসান না কেন, ব্রিটিশ শাসন পর্বের শুরু থেকেই নব্যন্যায়ের পীঠস্থান নবদ্বীপের সংস্কৃত চর্চার গৌরব ম্লান হতে শুরু করেছিল। তীব্র অর্থাভাবের কারণে ব্যাহত পঠনপাঠন, শিক্ষান্তে ছাত্রদের উপাধি দানে দেখা দিল বিশৃঙ্খলা। বিদেশি শাসকের আনুকূল্য পাওয়া যাবে না বুঝতে পেরে নবদ্বীপের পণ্ডিত সমাজ সে সময়ে এক শিক্ষা সংসদ তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন। স্থাপিত হল সংস্কৃত বিদ্যাবিবদ্ধনী বিদগ্ধজননী সভা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৪ ০০:০০
Share:

বঙ্গ বিবুধ জননী সভা

Advertisement

পুনশ্চ দেবভাষা

ইংরেজ পণ্ডিতেরা যতই নবদ্বীপকে অক্সফোর্ডের সঙ্গে একাসনে বসান না কেন, ব্রিটিশ শাসন পর্বের শুরু থেকেই নব্যন্যায়ের পীঠস্থান নবদ্বীপের সংস্কৃত চর্চার গৌরব ম্লান হতে শুরু করেছিল। তীব্র অর্থাভাবের কারণে ব্যাহত পঠনপাঠন, শিক্ষান্তে ছাত্রদের উপাধি দানে দেখা দিল বিশৃঙ্খলা। বিদেশি শাসকের আনুকূল্য পাওয়া যাবে না বুঝতে পেরে নবদ্বীপের পণ্ডিত সমাজ সে সময়ে এক শিক্ষা সংসদ তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন। স্থাপিত হল সংস্কৃত বিদ্যাবিবদ্ধনী বিদগ্ধজননী সভা।সময়টা ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দ। পাইকপাড়ার রাজা ইন্দ্রচন্দ্র সিংহকে সভাপতি এবং অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মহেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে সম্পাদক নির্বাচিত করে দেশের পণ্ডিতমণ্ডলী এবং সংস্কৃতের অধ্যাপকদের এক সঙ্গে নিয়ে সংস্কৃত চর্চাকে একটা সুশৃঙ্খল রূপ দেওয়ার উদ্দেশে এই সভা স্থাপন করা হয়। ১৮৯৭ সালে সভার নাম পরিবর্তন করে রাখা হল ‘বঙ্গ বিবুধ জননী সভা।’ সভাপতি হলেন তত্‌কালীন নদিয়ারাজ ক্ষিতীশচন্দ্র রায়। ১৯০৬ সালে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এই সভার সভাপতি নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু সেই পদে ছিলেন। বঙ্গ বিবুধ জননী সভা স্যার আশুতোষকে ‘সরস্বতী’ উপাধিতে ভূষিত করে। যে উপাধিকে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্মান বলে মনে করতেন আশুতোষ। পরবর্তী কালে বহু বিশিষ্ট পণ্ডিত এই সভার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। যাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বিজনকুমার মুখোপাধ্যায়, সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ প্রমুখ। এই সভার পরিচালনায় নির্দিষ্ট পাঠক্রম অনুসারে সংস্কৃত ভাষায় বিভিন্ন বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হত এবং ‘রত্ন’ উপাধি দেওয়া হত। পরবর্তী কালে সংস্কৃত শিক্ষা পরিষদ এই পাঠক্রম এবং পরীক্ষা পদ্ধতি গ্রহণ করে। তবে ‘রত্নের’ বদলে ‘তীর্থ’ উপাধি দানের ব্যবস্থা করে। এক সময়ে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় সভার ২৮টি কেন্দ্র ছিল। শুধু সংস্কৃত শিক্ষা নয়, দুষ্প্রাপ্য পুঁথি, গ্রন্থ সংরক্ষণের প্রশিক্ষণও দেওয়া হত। তবে এ সবই গৌরবময় অতীত। ১২৮ বছরের ভাষাচর্চার সুদীর্ঘ ইতিহাস বুকে নিয়ে বঙ্গ বিবুধ জননী সভা এখন ধুঁকছে। বুনো রামনাথের ভিটের ওপর ৩৮ কাঠা জমি নিয়ে গড়ে ওঠা এই প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডটুকুও চোখে পড়ে না। পোড়োবাড়ির চেহারা নিয়েছে ভবনটি। সেখানেই গত রবিবার বসেছিল পরিচালন সমিতির সভা। নতুন করে বঙ্গ বিবুধ জননী সভাকে তার হারানো গৌরবের ভগ্নাংশও যদি ফিরিয়ে দেওয়া যায়, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। অভাবকে সঙ্গী করেই জন্ম হয়েছিল এই প্রতিষ্ঠানের। স্যার আশুতোষ বলেছিলেন যে, এমন প্রতিষ্ঠানের জন্য তিনি ভিক্ষাপাত্র হাতে দরজায় দরজায় যেতে প্রস্তুত। সভার বর্তমান পরিচালকেরা সত্যিই ভিক্ষাপাত্র হাতে নামতে প্রস্তুত।

Advertisement

ব্রাভো বভ্রুবাহন

রসায়নের জটিল পরীক্ষা সবে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছেন অধ্যাপক। হঠাত্‌ই এক ছাত্র চিত্‌কার করে উঠল, ‘ব্রাভো বভ্রুবাহন, ব্রাভো!’ ব্যাপার কী? না, অধ্যাপক তো শুধু অধ্যাপক নন, তিনি যে থিয়েটারের নামকরা অভিনেতা, নাট্যকারও। সেই সময়ে শহর কলকাতায় মানুষের মুখে-মুখে ‘চিচিং ফাঁক’ কিংবা ‘ছি ছি এত্তা জঞ্জাল।’ ক্ষীরোদপ্রসাদের আলিবাবা মঞ্চ কাঁপাচ্ছে। দিনে তিনি অধ্যাপক ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, সন্ধ্যায় নট। পরীক্ষাগারে নকল সোনা তৈরির চেষ্টা করেছিলেন যিনি, তিনিই সোনা ফলিয়েছেন বাংলা রঙ্গমঞ্চে। অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় লিখেছেন “আলিবাবা প্রভৃতির অভিনয় দেখিতে দেখিতে বিডন স্ট্রিটের দর্শকবৃন্দ বোলচাল কাটিয়া শিষ দিয়া, দুই একটা অসঙ্গত ইয়ার্কি কপচাইয়া একটু হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল। অমরেন্দ্রনাথ (দত্ত) থিয়েটারকে একটি সর্বজাতীয় আমোদাগারে পরিণত করিলেন। থিয়েটার যেন বুরোক্রেসির রাজত্ব ছিল, অমরবাবু থিয়েটারকে ডেমোক্রেট করিয়া তুলিলেন। ফলে দাঁড়াইল, ক্লাসিকে যখন ‘বাদুড় ঝোলে’ স্টারের বেঞ্চ তখন শূন্য।” এ হেন নাট্যকারকে শেষ জীবনে বহু হতাশা নিয়ে বাঁকুড়া শহরের কাছে বিকনা গ্রামে বসবাস করতে হয়েছিল। তাঁর জন্মের দেড়শো বছর পেরিয়ে গেল। সম্প্রতি বিকনা-র স্কুলে একটি অনুষ্ঠান ছাড়া তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ল কই?

সৌরজল

সূর্যের শক্তি কাজে লাগিয়ে রান্নার গ্যাস বা বিদ্যুতের বিল কমানোর কথা বলে সবাই, কিন্তু করে ক’জন? যারা করে দেখাচ্ছে, তাদের মধ্যে এ বার নাম লেখাল বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়। সৌরশক্তি দিয়ে জল গরমের যন্ত্র (সোলার ওয়াটার হিটার) বসল হস্টেলে। মেদিনীপুর শহরে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পাঁচটি হস্টেলে মোট ৬২০ জন পড়ুয়া ছাড়াও শিক্ষক-শিক্ষা কর্মীরাও থাকেন। নিউ হস্টেলে মোট আবাসিক ১২০ জন।

এত লোকের রান্না করতে হস্টেলে মাসে দশটি এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডারের প্রয়োজন হয়। যা দেখে চক্ষু চড়কগাছ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। গ্যাস সাশ্রয় করতেই এই উদ্যোগ। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের যুক্তি, ভাত-সহ নানা খাবার তৈরিতে জল গরম করতেই বেশি গ্যাস খরচ হয়। তাছাড়াও শীতকালে স্নান ও পানীয় জল হিসাবেও হিটারের গরম জল ব্যবহার করতে পারবেন ছাত্রছাত্রীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রার জয়ন্তকিশোর নন্দীর ব্যাখ্যা, ওই যন্ত্র বসিয়ে গ্যাস সাশ্রয় হচ্ছে কি না, তা দেখা হচ্ছে। মাসখানেকের মধ্যেই অন্তত দুটি দু’টি গ্যাস সিলিন্ডার কম খরচ হয়েছে বলে দেখা গিয়েছে। আরও মাস তিনেক দেখে, সবকটি হস্টেলেই গ্যাস সাশ্রয়ের জন্য ওই যন্ত্র বসানো হবে।

বাংলাদেশে যুগাগ্নি

চার দিনের বাংলাদেশ সফরে যাচ্ছে বহরমপুরের নাট্যদল যুগাগ্নি। আগামী ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা শিল্পকলা চর্চা কেন্দ্রে মঞ্চস্থ হবে সন্দীপন মজুমদারের নাটক ‘ঈশ্বর এসেছে’। বাংলাদেশের গঙ্গা-যমুনা নাট্যোত্‌সব পর্ষদ প্রতি বছর ঢাকায় নাট্যোত্‌সবের আয়োজন করে থাকে। রাজ্যের তিনটে নাটকের দলকে ওই নাট্যোত্‌সবে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে কলকাতার দুটি নাটকের দল অনীক ও চুপকথা, এবং বহরমপুরের যুগাগ্নি। এই নিয়ে তিন বার বাংলাদেশ সফরে যাচ্ছে যুগাগ্নি। প্রায় ৩২ জনের ওই নাটকের দল আগামী ৩ সেপ্টেম্বর বহরমপুর থেকে রওনা দেবে। বাংলাদেশ সফরে যাওয়ার আগে বহরমপুরে জেলা প্রশাসনিক ভবনের ঠিক উল্টো দিকে মহলা কক্ষে জোর কদমে নাটকের মহড়া চলছে।

মাটির কবি

‘মাটিতে বীজ ছড়িয়ে গরম ভাত’-এর খোঁজে থাকা কবি অভিমন্যু মাহাতো এ বছর ‘সাহিত্য অ্যাকাডেমি যুব পুরস্কার ২০১৪’ পাচ্ছেন তাঁর ‘মাটি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য। পুরুলিয়া শহর থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরের গ্রাম শরবেড়িয়ায়, ১৯৮৩ সালে এই নবীন কবির জন্ম। সেখানে কুরমি সম্প্রদায়ের দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের বাস। তাঁরা কথা বলেন ‘কুড়মালি’ ভাষায়। পুরুষেরা দিনভর খেতে কাজ করেন, আর অবসরে ছৌ নাচেন। মেয়েরা ধানের ‘ভাড়াকুটি’ করেন। এমন গ্রামে বাবা চৈতু মাহাতো আর দাদাদের নাচ দেখতে দেখতেই বেড়ে ওঠা অভিমন্যুর। ২০০৮ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ ‘আওলা বরষা ধনি’। এর কয়েক বছর পরে ২০১২ সালে সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত কবিতার বই ‘মাটি’। এর মধ্যে অবশ্য ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে ‘জোহার’ ও চলতি বছর ‘আমার নাম জঙ্গলমহল’ নামে আরও দুটি কবিতার বই। ‘জোহার’ কাব্যটি ‘কুড়মালি’ ভাষায় বাংলা হরফে ছাপা। কেননা কুড়মালি ভাষায় কোনও লিপি নেই। পেশায় একটি দৈনিক বাংলা সংবাদপত্রের সাংবাদিক অভিমন্যু নিজেও ছৌ শিল্পী। তাঁর সম্পাদিত ছোটদের পত্রিকা ‘সবুজ চিঠি’। তিনি জানেন, ‘আমনে এবার উত্‌সব নেই, কুটুম্বিতা হয়তো হবে না/ লালদানা ভাতের জন্য তবু রাতপাহারা’ দেয় তাঁর কলম।

সাঁতরা ও তারপর

তারাপদ সাঁতরাকে কোনও দিন তিনি চোখে দেখেননি, বই পড়েছেন। এক দিন হঠাত্‌ মৃত্যুশয্যায় থাকা তারাপদবাবুকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় আনন্দবাজার পত্রিকায়। পেশায় ইংরেজির শিক্ষক সোমনাথ রায় সে দিনই ঠিক করে ফেললেন তাঁর আগামীর কর্মসূচি। দুর্গাপুর সংলগ্ন গোপালমাঠ গ্রামের বাসিন্দা সোমনাথবাবু উখড়া ও সিহাড়শোলের রথ দিয়ে শুরু করলেন প্রত্নতত্ত্বের ক্ষেত্র সমীক্ষার কাজ। সেন্টার ফর আর্কিওলজিক্যাল স্টাডিজের সেমিনারে তুলে ধরলেন তাঁর সমীক্ষার ফল। মন্দির সমীক্ষার প্রথাগত পাঠ যজ্ঞেশ্বর চৌধুরীর কাছে। ক্ষেত্র সমীক্ষা করতে গিয়ে বুঝলেন, অতীতের প্রতি অবহেলার ফলে হারিয়ে যাচ্ছে রাঢ় বাংলার ইতিহাস। আর তাই নিজেই বানিয়ে ফেললেন প্রত্ন যাদুঘর আর লিট্ ম্যাগ গ্রন্থাগার, নামকরণ করা হল ‘তারাপদ সাঁতরা প্রত্নশালা ও লিটল ম্যাগ আর্কাইভ’। যাদুঘর তৈরির দু’লক্ষ টাকা এল সোমনাথবাবু স্কুলের কো-অপারেটিভ থেকে, ঋণ হিসাবে। গ্রন্থাগারের কাজে সাহায্য করলেন কলকাতার লিটল ম্যাগ সংগ্রাহক সন্দীপ দত্ত। যাদুঘরের বর্তমান সংগ্রহে যেমন রয়েছে শতাধিক প্রাচীন পঁুথি, এক হাজারের মত বিষয়ভিত্তিক ক্যালেণ্ডার তেমনই রয়েছে প্রাচীন মুদ্রা, লোকশিল্পের পট, মধ্যযুগের বাংলার মুখোশ প্রভৃতি। যাদুঘরকে শুধুই সংগ্রহশালা করেই রাখতে চাননি তিনি। তাই হেরিটেজ কমিশনের সাথে মিলিতভাবে আয়োজন করছেন ‘ঐতিহ্য বস্ত্ু সচেতনতা কর্মশালা।’ পড়ুয়া থেকে গবেষক সকলের জন্যই দরজা খোলা। যাদুঘর ও গ্রন্থাগারের তরফে প্রকাশিত পত্রিকা, ‘পুরালোক বার্তা’ তারাপদ সাঁতরার সমস্ত অগ্রন্থিত লেখা এবং চিঠিপত্র প্রকাশ করতেও উদ্যোগ নিয়েছে। এতদিন প্রায় কোনও সরকারি সাহায্য না মিললেও ভারতীয় যাদুঘরের পরিদর্শকরা সোমনাথবাবুর তৈরি যাদুঘরে আসবেন বলে জানা গিয়েছে। সোমনাথবাবু জানান বীরভানপুর ও নডিহাতেও খননের অনুমতি মিলবে শীঘ্রই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন