মালদহের হোটেলে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে এসি-বিভ্রাটের পিছনে ‘গভীর ষড়যন্ত্রের সম্ভাবনা’ রয়েছে বলে বৃহস্পতিবারই নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ করেছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। ইঞ্জিনিয়ার এবং এসি মেরামতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা যদিও মুকুলবাবুর সেই আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের মতে, হোটেলে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে এসি মেশিন ফেটে যে ভাবে ধোঁয়া বেরিয়েছে তা গরমকালে অস্বাভাবিক কিছু নয়। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ না হলে কিংবা মামুলি সংস্থার এসি ব্যবহার করলে এই ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়ে। প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘরে প্রায় অচেনা একটি সংস্থার স্প্লিট এসি লাগানো ছিল।
ইঞ্জিনিয়াররা এই কথা বললেও রাজ্য সরকার কিন্তু বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েই দেখছে। মালদহ ছাড়ার আগে মুখ্যমন্ত্রী খোদ জানিয়েছেন, “বৃহস্পতিবার সারা রাত স্যালাইন, অক্সিজেন নিয়েছি। এখন তো নির্বাচন, ঘরে থাকা যায়?” ঘটনার গুরুত্ব বোঝাতে মমতার মন্তব্য, “দমকলের লোকেরা বললেন, ম্যাডাম আপনি আর এক মিনিট ঘরে থাকলে মারা যেতেন।” এ দিনই ওই হোটেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা দায়ের করে তদন্ত শুরু করেছে দমকল। কলকাতা থেকে ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে ফরেন্সিক দলও। সূত্রের খবর, তারা বৈদ্যুতিক সরঞ্জামে ত্রুটির বিষয়টিতেই জোর দিচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী পরিবহণমন্ত্রী মন্ত্রী মদন মিত্র আগেই বিষয়টিকে ‘চক্রান্ত’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। তবে মালদহের দলীয় নেতা তথা আর এক মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী বলেন, “চক্রান্ত হয়েছে কি না তা এখনই বলা যাবে না।”
রাজ্যের পুরো নিরাপত্তা ব্যবস্থা যে হেতু এখন নির্বাচন কমিশনের অধীনে, তাই মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার জন্য বৃহস্পতিবার কমিশনকেই দুষেছিলেন মুকুলবাবু। এ দিন কমিশন সূত্রে বলা হয়েছে, জেড প্লাস নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব তাদের নয়। মালদহের ওই হোটেলও কমিশন ভাড়া করেনি। ফলে হোটেলের শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রে গোলযোগের দায়ও কমিশনের নয়।
হোটেলটির মালিক দিলীপ অগ্রবাল বৃহস্পতিবার বিষয়টিকে সাধারণ বৈদ্যুতিক গোলযোগের ঘটনা বলেই দাবি করেছিলেন। এ দিন স্থানীয় ইলেকট্রিক মিস্ত্রিরাও একই কথা বলেছেন। বিদ্যুৎ-ইঞ্জিনিয়ারদের বক্তব্য, এসি মেশিন ব্যবহারের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হল রক্ষণাবেক্ষণ। কিন্তু এসি-তে কোনও সমস্যা হলে সাধারণত পাড়ার মিস্ত্রি ডেকেই সারিয়ে নেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে ব্র্যান্ডেড মেশিন সারানোর সময়ে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বদলে স্থানীয় কোনও সংস্থার তৈরি যন্ত্রাংশ লাগিয়েই কাজ সারা হয়, যা একেবারেই অনুচিত। ইঞ্জিনিয়ারদের মতে, মূলত এই সমস্ত কারণেই গ্রীষ্মে বিভিন্ন জায়গায় এসি মেশিনে শর্ট সার্কিট হয়ে আগুন লাগার কথা শোনা যায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এক শিক্ষক জানাচ্ছেন, এসি মেশিনের মোটরের কী অবস্থা, তা অনেক সময়েই ব্যবহারকারী খেয়াল করেন না। ফলে মেশিন চলতে চলতে গরম হতে থাকে। এক সময়ে শর্ট সার্কিট হয়ে কন্ডেনসার ফেটে যায় বা অন্য কোনও বিভ্রাট থেকে আগুন লেগে যায়। এই জন্যই নিয়ম করে মেশিনের রক্ষণাবেক্ষণ দরকার। না হলে শর্ট সার্কিট হতে বাধ্য।
ঘটনার পর হোটেলের কর্মীদের অনেকে অভিযোগ করেছিলেন যে, ওই দিন দুপুরেই বণ্টন সংস্থা হোটেলের ৬৩ কেভি-র ট্রান্সফর্মারটি পাল্টে ১০০ কেভি-র ট্রান্সফর্মার লাগানোর পর থেকেই ভোল্টেজ ওঠানামা করছিল। তার ফলেই মেশিনে শর্ট সার্কিট হয়ে থাকতে পারে বলে তাঁদের সন্দেহ। যদিও জেলা বিদ্যুৎ দফতরের ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার শৈবাল মজুমদার দাবি করেন, তাঁদের দিক থেকে কোনও সমস্যা হয়নি। হোটেলের সার্কিটে সমস্যা থাকতে পারে। তিনি এ-ও বলেন, ওই হোটেল কর্তৃপক্ষকে বাল্ক কানেকশন নিতে বলেছিলেন তাঁরা। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সে কথা শোনেননি।
ইঞ্জিনিয়ার ও প্রতিষ্ঠিত এসি মেশিন প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলির হয়ে যাঁরা রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করেন তাঁদের অনেকের মতে, ভোল্টেজ আপ-ডাউন হতেই পারে। সে ক্ষেত্রে দেখতে হবে, শর্ট সার্কিটের সম্ভাবনা রুখতে কী কী সুরক্ষা-কবচ নেওয়া হয়েছে। মেশিনের কম্প্রেসার এবং কন্ডেনসার যাতে কাজ করতে
গিয়ে হোঁচট না খায়, তার বন্দোবস্ত করার দায়িত্ব ব্যবহারকারীর। তাই সুরক্ষা ব্যবস্থা ঠিক থাকলে দুর্ঘটনা এড়ানোও সম্ভব।
তবে বৃহস্পতিবারের ঘটনার জেরে বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। সংস্থার চেয়ারম্যান নারায়ণস্বরূপ নিগম বলেন, “যে হেতু মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে শর্ট সার্কিটের ঘটনা ঘটেছে, তাই সব দিক তদন্ত করে দেখা হবে।” ট্রান্সফর্মার থেকে হোটেল পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং হোটেলের ভিতরে ইলেকট্রিক ওয়্যারিংয়ের অবস্থা কী ছিল, তা খতিয়ে দেখে যত শীঘ্র সম্ভব রিপোর্ট দেবে কমিটি। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য ২০ এপ্রিল পর্যন্ত ওই হোটেলেই থাকবেন বলে মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী জানিয়েছেন।
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী এই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে উপযুক্ত তদন্ত দাবি করেছেন। তাঁর কথায়, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু একটি দলের নেত্রী নন, একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও বটে। তাই তাঁর নিরাপত্তার বিষয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।” মালদহের কালিয়াচকের সভায় এ দিন প্রয়োজনে ওই ঘটনার সিবিআই তদন্ত করানোর দাবিও তুলেছেন অধীর। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু আবার বলেছেন, সত্য উদঘাটনের প্রয়োজনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করানো হোক। তাঁর বক্তব্য, “আগেই বলেছি, আমরা উদ্বিগ্ন। মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র হওয়া উচিত। যেখানে থাকবেন, সেখানে আগে থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা উচিত। কিন্তু শুধু চক্রান্তের কথা বললে হবে না। তদন্ত করতে হবে। কারা, কোথায়, কেন চক্রান্ত করল, সে সব স্পষ্ট করতে হবে।”
দলের ওয়েবসাইটে এ দিন তৃণমূলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন লিখেছেন, “ঈশ্বরের কৃপায় অগ্নিকাণ্ডের ধকল কাটিয়ে দিদি ওঁর কর্মসূচি চালাতে পারছেন। আর রাজ্য, এমনকী, দেশ জুড়ে অগণিত মানুষ দিদির খোঁজ নিয়েছেন, দিদির জন্য প্রার্থনা করেছেন। তাঁদের প্রত্যেককে ধন্যবাদ।”