কথা হল। নজরুল মঞ্চের অনুষ্ঠানে মুখোমুখি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শুভাপ্রসন্ন। শুক্রবার সুদীপ আচার্যের তোলা ছবি।
আগের মতো প্রাণখোলা আলাপচারিতা করলেন না ঠিকই, কিন্তু প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্নকে পুরোপুরি ব্রাত্য করেও রাখলেন না মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সারদা তদন্তের দিকে ইঙ্গিত করে বুধবার পৈলানে দলীয় কর্মীদের সভায় তৃণমূল নেত্রী বলেছিলেন, “শুভাপ্রসন্ন একটি চ্যানেল বিক্রি করেছে। তার তদন্ত চলছে। হয়তো দোষী সাব্যস্ত হতে পারে। আমি ওকে সাপোর্ট করছি না।” তাঁর এই মন্তব্য ঘিরে যখন দলের অন্দরেই নানা জল্পনা, তখন শুক্রবার নজরুল মঞ্চে এক সরকারি অনুষ্ঠানে সেই শুভাপ্রসন্নর সঙ্গেই ঘণ্টা দেড়েক এক মঞ্চে দেখা গেল মমতাকে। দু’জনের মধ্যে মিনিটখানেক বাক্য বিনিময় হল। এমনকী নিজের বক্তৃতায় এক বার ‘শুভাদা’র নামও উল্লেখ করলেন মমতা।
সারদা-কাণ্ডে শুভাপ্রসন্নর নাম জড়িয়েছে আগেই। তার পর পৈলানে মুখ্যমন্ত্রীর ওই মন্তব্য নিয়ে তৃণমূলের অন্দরেই প্রশ্ন উঠেছিল, তবে কি নিজের ঘনিষ্ঠ বৃত্ত থেকে এই চিত্রশিল্পীকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন মমতা? সারদা-কাণ্ডে সিবিআইয়ের ডাক পাওয়ার পরেও মমতার বিজয়া সম্মিলনীর ভোজসভায় হাজির ছিলেন শুভাপ্রসন্ন। সেখানে সর্বসমক্ষে তাঁকে ‘মনোবল হারিয়ে না ফেলতে’ পরামর্শ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তা হলে পৈলানের দলীয় বৈঠকে কেন হঠাৎ প্রসঙ্গ-বহির্ভূত ভাবে শুভার নাম টেনেছিলেন তিনি? এ দিন প্রকাশ্যে এক ছাদের তলায় শুভাপ্রসন্নকে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখে অনেকে বলছেন, মমতা এ দিন স্রেফ সৌজন্য দেখিয়েছেন। তার বেশি কিছু নয়। আগের ‘ঘনিষ্ঠতা’ এ দিন ছিল না।
তবে কেউ কেউ বলছেন, সারদা-কাণ্ডে জড়িয়ে পড়া শুভাপ্রসন্নকে এ দিন একই মঞ্চে তুলে মমতা বোঝাতে চেয়েছেন, তিনি বিষয়টিকে কোনও গুরুত্বই দিচ্ছেন না। বরং দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের ক্ষেত্রে নেত্রীর আচরণে সম্প্রতি যেমন টানাপড়েন দেখা গিয়েছে, ‘শুভাদা’র ক্ষেত্রে তারই ছায়া দেখা গেল। নেত্রীর সঙ্গে মনোমালিন্যের পর্যায় পেরিয়ে আবার তাঁর পছন্দের মানুষের বৃত্তে ঢুকে পড়েছেন মুকুল। মমতার গাড়িতে আবার তাঁর জায়গা হচ্ছে। মমতা প্রকাশ্যে বলছেন, তিনি মুকুলকে দিনে ‘পাঁচশো বার’ ফোন করেন। এর পরেই তৃণমূলের একাংশ বলতে শুরু করেছিল, এই মিটমাট হওয়ারই ছিল। শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রীর মঞ্চে শুভার উপস্থিতির পিছনেও একই সমীকরণ দেখছেন অনেকে। ঘটনাচক্রে, সাময়িক ভাবে ব্রাত্য থাকার পর এ দিনই রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রত্যাবর্তন ঘটেছে পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র ও বস্ত্রমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের। সারদা তদন্তে যে দু’জনের নাম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে উঠে এসেছে।
এ দিন নজরুল মঞ্চে মমতা ঢোকেন বিকেল ৫টা ১০ নাগাদ। তাঁর কয়েক হাত পিছনেই আসতে দেখা যায় শুভাপ্রসন্নকে। মঞ্চের নীচে পাতা সোফায় নেত্রী বসেন। তাঁর এক পাশে শুভাপ্রসন্ন, আর এক পাশে স্বাস্থ্য দফতরের মা ও শিশু সংক্রান্ত টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সময় নিচু গলায় মিনিটখানেক কথা বলতে দেখা যায় তাঁদের। এমন ‘ফ্রেম’ পেয়ে ছুটে যান আলোকচিত্রীরা। সঙ্গে-সঙ্গে সোফা থেকে উঠে মঞ্চে চলে যান মুখ্যমন্ত্রী। মমতার সঙ্গে মঞ্চে বসার জন্য অনুষ্ঠানের ঘোষিকা যাঁদের নাম ডাকেন, সেই তালিকায় শুভাপ্রসন্ন ছিলেন না। কিন্তু দেখা যায়, মঞ্চের ডান দিক দিয়ে শুভাপ্রসন্নকে নিয়ে উঠে আসছেন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। তিনি বসেন মমতার বাঁ দিকে কয়েকটি চেয়ার ছেড়ে।
হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে প্রবীণ চিত্রশিল্পী স্বাভাবিক থাকার জন্য কি একটু বেশি রকম হাসছেন এই আলোচনা তখন প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে। কখনও ফিরহাদ হাকিম, কখনও সুব্রত মুখোপাধ্যায়, আবার কখনও পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে গল্প-খুনসুটি করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। ছোট একটি কৌটো থেকে বিস্কুট জাতীয় কিছু একটা নেতা-মন্ত্রীদের খাওয়াতেও দেখা গিয়েছে শুভাপ্রসন্নকে। মঞ্চে তাঁর সঙ্গে কথা না বললেও নিজের বক্তৃতায় এক বার ‘শুভাদা’র নাম নিলেন মুখ্যমন্ত্রী। আর তা শুনে দর্শকাসন থেকে গুঞ্জন উঠল ‘‘নাম বলল! নাম বলল!”
অনুষ্ঠান শেষে মঞ্চে উপস্থিত সকলের সঙ্গে শুভাপ্রসন্নও মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গিয়ে বিদায় জানিয়ে এলেন। হাসি ও নমস্কার বিনিময় হল। তার পর মঞ্চ ছাড়লেন দু’জনেই।