মংপুর রবীন্দ্রভবন।
বাজার করে দেব। যা খেতে চাইবেন, বানিয়ে দেব। কোনও দরকার হলেই বলবেন স্যার!
অবেলায় ইমার্জেন্সি বুকিং নিয়ে এসে-পড়া অতিথিকেও পরম আন্তরিকতায় এমন আশ্বাস দিয়ে থাকেন অনিল শর্মা। দোহারা চেহারা, মৃদুভাষী নেপালি প্রৌঢ়। নিজের হাতে রেঁধে-বেড়ে অতিথিদের তৃপ্ত করা থেকে ঘরদোর সাফসুতরো করা— সব কাজেই তাঁর দু’হাত ভরসা। আগন্তুক যদি এসে আবিষ্কার করেন রিসর্টের ডিশ টিভি অচল, দৌড়ে গিয়ে রিচার্জ করিয়েও এনে দিতে পারেন অনিল! পারেন না শুধু একটা কাজই! রাতে লোডশেডিং হলে জেনারেটর চলবে? অনিল উত্তর দেন, “সব কাজ করে দেব স্যার। ওইটা পারি না। জেনারেটর চালালেই মোবিল পড়ে যায় খালি!”
অগত্যা অতিথিকে মেনে নিতে হয়, রাতে লোডশেডিং হলে অন্ধকারই ভরসা! পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বন উন্নয়ন নিগম যেমন জানে, পাহাড়ের কোলে গরুবাথানের ফরেস্ট রিসর্টে অনিলই ভরসা। দু’কামরার রিসর্টের একমাত্র কেয়ার টেকার। তাঁর ভরসাতেই পর্যটকেরা আসেন-যান। নিগমও পর্যটনের ব্যবসা চালিয়ে যায়।
ডুয়ার্সের চেল নদী।
লাভা যাওয়ার রাস্তা ছেড়ে গরুবাথান ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কাছে বাজার পেরিয়ে ঢাল ধরে নীচে চলে গেলে মাল বস্তি। সেখানেই বাড়ি অনিলের। পরিবার থাকে সেখানেই। কাছেপিঠে থেকেও অনিলের অবশ্য যখন ইচ্ছে বাড়ি যাওয়া হয় না। রিসর্ট রাতে ফাঁকা রাখা যাবে না বলে নিগমের ফরমান আছে। অথচ চৌহদ্দিতে কোনও নিরাপত্তারক্ষী নেই! নজরদারির জন্য চৌকিদার পর্যন্ত চোখে পড়বে না। গোর্খাল্যান্ডের জন্য আন্দোলনের নামে যে রিসর্টের চারটি ঘর (কাঠের মেঝে সংবলিত যে অংশ ছিল মূল পর্যটক আকর্ষণ) বছর তিনেক আগে পুড়িয়ে দিয়েছিল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা, তার নিরাপত্তাও এখন কার্যত একা অনিলের হাতে!
ঠিক যেমন একা কুম্ভ হয়ে মংপুর রবীন্দ্র ভবন সামলাচ্ছেন শিশির রাউত। তিনি অবশ্য রাতে রবীন্দ্রনাথের এই শৈল নিবাসে থাকেন না। আসেন সকালে। গোটা বাড়ি জুড়ে ছড়িয়ে থাকা নোবেলজয়ী কবির ব্যবহৃত নানা সামগ্রী, কিছু আসবাব, একগুচ্ছ চিঠি এবং ছবি— সবই আগলে রেখেছেন একা শিশির। উৎসাহী অতিথি পেলে যিনি বলেন, “আমি এটা ভালবেসে করি। আপনাদের এই বাড়ি দেখানোর জন্যই আমি আছি। গুরুদেবের কী স্মৃতি এখানে আছে, সকলের জানা উচিত!”
আরিফ হোসেন
শিশির রাউত
অনিল যেমন মাল বস্তির নিতান্ত নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে নিগমের কেয়ার টেকার হয়েছেন, শিশিরের বংশ-বৃত্তান্ত আবার অন্য রকম ভাবে তার চেয়ে অনেক আকর্ষণীয়। আর্থ-সামাজিক ভাবে হয়তো অনিলেরই সমগোত্র। তবু শিশিরের পরিবারের রবীন্দ্র-কৌলীন্য আছে। সেই ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত জীবন সায়াহ্নের যে সময় কালে রবীন্দ্রনাথ দার্জিলিঙের কার্শিয়াং মহকুমার মংপুতে মৈত্রেয়ী দেবীর ব্যবস্থাপনার এই বাড়িতে আসতেন, তখন বাড়ির দরজা পর্যন্ত গাড়ি পৌঁছনোর সুযোগ ছিল না। প্রায় ১২ কিলোমিটার নীচে গাড়ি ছেড়ে অশক্ত শরীরের রবীন্দ্রনাথকে পালকি চাপিয়ে মংপুতে নিয়ে আসতেন চার জন। সেই চার পালকি-বাহকের এক জন ছিলেন ভীমলাল রাউত। শিশিরের দাদু। পারিবারিক সূত্রে বিশ্বকবির সঙ্গে তাঁর যে সংযোগ, তাকেই পুঁজি করে নিখাদ ভালবাসার একটি দায়িত্ব পালন করে চলেছেন শিশির। তবে সে সবের মাঝেই তাঁর একটি মোক্ষম প্রশ্ন আছে, যার উত্তর কে দেবে জানা নেই! শিশির বলেন, “আমি যতটা পেরেছি, বাঁচিয়ে রেখেছি। কিন্তু গুরুদেবের নিজের হাতে লেখা চিঠি, আঁকা ছবি বা ব্যবহৃত কিছু জিনিস এই ভাবে কত দিন বাঁচানো যাবে? এই তো চেয়ারটা প্রায় নষ্ট হয়ে গিয়েছে। গদিটা এখনও বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। এ সব জিনিস বাঁচাতে এ দেশের কোথাও কেউ এগিয়ে আসবে না?” শিশির আসলে বোঝাতে চাইছেন রবীন্দ্র-স্মৃতি সংরক্ষণে বিশেষজ্ঞ সাহায্যের কথা।
মুর্শিদাবাদের মতিঝিলের আরিফ হোসেন অনিল-শিশিরদের চেয়ে একটু ভাগ্যবান মনে করতে পারেন নিজেকে! ঘঁসেটি বেগমের স্মৃতি বিজড়িত মতিঝিলকে ঘিরে পর্যটন প্রকল্প করার কথা শেষ পর্যন্ত মাথায় এসেছে রাজ্য সরকারের। অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদকে ঘিরে বাগান গড়ে তোলার কাজ শুরুও হয়েছে। মতিঝিলের একপ্রান্তে তাঁর স্বামীর তৈরি করে দেওয়া প্রাসাদে বসে মেহর-উন-নিসা বেগম ওরফে ঘঁসেটি কী ভাবে মীর জাফর, জগৎ শেঠ, উমি চাঁদদের সঙ্গে সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে নানা চক্রান্তের জাল বুনতেন, সে সব বৃত্তান্ত মুখস্থ আরিফের। মতিঝিল মসজিদের সামনে কোনটা ঘঁসেটির কবর, কোনটা সিরাজের ভাই ইক্রম-উদ-দৌলার (ঘঁসেটির পালিত পুত্র) সমাধি, এ সবও বলে যেতে পারেন গড়গড়িয়ে। মতিঝিল মসজিদের গায়ে চার দিক বন্ধ যে ঘর কামানের গোলার আঘাত-চিহ্ন সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার রহস্য ভাঙতে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন আরিফ। ঘঁসেটির মৃত্যুর পরে তাঁর গুপ্তধন এই ঘরে আছে মনে করে কামান দিয়ে ভাঙতে গিয়েছিলেন যে ব্রিটিশ সাহেব, কথিত আছে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল আকস্মিক ভাবে। সেই সাহেবের ১৫ বছরের পুত্রও মারা যায় কয়েক দিন পরে। সেই ইংরেজ বালকের সমাধি ফলকের কাছে চেয়ার নিয়ে বসে আরিফ বলেন, “আমার বাপ-ঠাকুর্দাও এখানে গাইড ছিলেন। তাঁরাও এই গল্প বলে আসতেন। সাহেবদের মৃত্যুর পরে সবাই ভয় পেয়ে গেল। আজও কেউ খোঁজ করার সাহস পায়নি এই বন্ধ ঘরে ঠিক কী আছে! এ রকম কত রহস্য যে এ দিকে ছড়িয়ে।”
কাটরা মসজিদ, মুর্শিদাবাদ
মতিঝিল মসজিদ
আরিফের আক্ষেপ, বাংলার ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য যে অধ্যায় মুর্শিদাবাদের এ সব অঞ্চলে খোদিত হয়ে আছে, তার সংরক্ষণে তেমন যত্নের ছোঁয়া পাওয়া গেল না! মুর্শিদাবাদ পুরসভার চেয়ারম্যান অবশ্য তাঁকে ভরসা দিচ্ছেন, মতিঝিলকে ঘিরে পর্যটন প্রকল্প তৈরি হয়ে গেলে পর্যটকদের ভিড় অনেক বাড়বে। তখন হয়তো আরও কিছু ব্যবস্থা হবে।
ভবিষ্যতের কথা এখনও ভবিষ্যতে। বর্তমানের প্রশ্ন, বুকিং করে যে পর্যটক গরুবাথানের রিসর্টে থাকতে যাবেন, মংপুর রবীন্দ্র-বাড়িতে যিনি কৌতূহল নিয়ে উপস্থিত হবেন বা মুর্শিদাবাদ-লালবাগে যাঁরা ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড়াতে চাইবেন, তাঁরা কি আরও একটু উন্নত পরিষেবা আশা করতে পারেন না? সামান্য উপার্জনে অনিল-আরিফেরা কত কিছু করবেন? কেন আরও পেশাদার হবে না এ রাজ্যের পর্যটন-মানচিত্রের ছবি? বন দফতরের এক কর্তা মেনে নিচ্ছেন, “এক জন কেয়ার টেকার দিয়ে কাজ চালানো সত্যিই সমস্যাজনক। আমাদের কর্মীদের বিভিন্ন জায়গায় স্থানান্তর করাকে ঘিরে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। আশা করছি, অবস্থা এর চেয়ে ভাল করা যাবে তাড়াতাড়িই।”
মংপুর সেই বাংলো
আশা নিয়ে অপেক্ষা চলতে থাকুক। তত দিন নিষ্প্রভ পর্যটনে অনিল-শিশির-আরিফেরাই জেনারেটর!
ছবি: লেখক।