তৃণমূলের মাথায় হাত

পয়লা দিনেই সিবিআই জালে মদন

সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার মধ্যেই যে এত বড় উইকেটটা পড়ে যাবে, ভাবেননি কেউই। সিবিআই অফিসারেরাও না, হেভিওয়েট অভিযুক্ত নিজে তো ননই। কিন্তু শুক্রবার ঠিক সেটাই ঘটল। দীর্ঘ টালবাহানার পরে সিবিআইয়ের সামনে সশরীর হাজিরার প্রথম দিনেই ভেঙে পড়লেন মদন মিত্র। দিল্লিতে ফোন করে অনুমতি চেয়ে নিয়ে তাঁকে তৎক্ষণাৎ গ্রেফতার করল সিবিআই। সারদা কেলেঙ্কারিতে রাজ্যের প্রথম মন্ত্রী, তৃণমূলের প্রথম শীর্ষস্থানীয় নেতার গ্রেফতারির ম্যাচটি বড়ই একপেশে হয়ে দেখা দিল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৪:০১
Share:

গ্রেফতারের পরে ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স থানার পথে মন্ত্রী। শুক্রবার রাতে। ছবি: সুমন বল্লভ।

সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার মধ্যেই যে এত বড় উইকেটটা পড়ে যাবে, ভাবেননি কেউই। সিবিআই অফিসারেরাও না, হেভিওয়েট অভিযুক্ত নিজে তো ননই।

Advertisement

কিন্তু শুক্রবার ঠিক সেটাই ঘটল। দীর্ঘ টালবাহানার পরে সিবিআইয়ের সামনে সশরীর হাজিরার প্রথম দিনেই ভেঙে পড়লেন মদন মিত্র। দিল্লিতে ফোন করে অনুমতি চেয়ে নিয়ে তাঁকে তৎক্ষণাৎ গ্রেফতার করল সিবিআই। সারদা কেলেঙ্কারিতে রাজ্যের প্রথম মন্ত্রী, তৃণমূলের প্রথম শীর্ষস্থানীয় নেতার গ্রেফতারির ম্যাচটি বড়ই একপেশে হয়ে দেখা দিল।

শীর্ষ আদালতের নির্দেশে সারদায় বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের তদন্ত করার দায়িত্ব পেয়েছে সিবিআই। পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি অসম-ওড়িশাতেও ছড়িয়ে রয়েছে তাদের জাল। এ রাজ্যে তারা ইতিমধ্যে প্রাক্তন ডিজি রজত মজুমদার, তৃণমূল সাংসদ সৃঞ্জয় বসু, ইস্টবেঙ্গল-কর্তা দেবব্রত সরকারের মতো একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু এত দিনে সরাসরি শাসক দলের মাথায় হাত পড়ল মদনকে গ্রেফতারির মধ্যে দিয়েই। এই প্রভাবশালীদের গ্রেফতারের দাবিতে বারবার সরব হয়েছিলেন সারদার অন্যতম অভিযুক্ত সাংসদ কুণাল ঘোষ, তৃণমূল-প্রাক্তনী আসিফ খান। আসিফ ক’দিন আগে দাবিও করেন, চলতি মাসে গ্রেফতার হবেন মদন। কুণাল-আসিফ, দু’জনেরই আশা এ দিন কিছুটা পূর্ণ হল।

Advertisement

কিন্তু রজত-সৃঞ্জয়-দেবব্রতদের ক্ষেত্রেও যা হয়নি, মদনের ক্ষেত্রে সেটাই হল। বাকিরা গ্রেফতার হয়েছেন বেশ কয়েক বার জেরার মুখোমুখি হওয়ার পরে। শুক্রবারও সকলে আশা করছিলেন মদন প্রথম বার হাজিরা দিচ্ছেন, এ দিনই অঘটন কিছু হয়তো ঘটবে না। তবে গ্রেফতারির সম্ভাবনা যে আছে, তা সবাই জানতেন। তলায় তলায় তার জন্য মানসিক প্রস্তুতিও চলছিল। আগের দিন মদনই গাঁধী-সুভাষের জেলযাত্রার প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী নিজে এ দিন জানিয়েছেন, গ্রেফতার হবেন আঁচ করে মদন আগাম পদত্যাগপত্রও জমা দিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু সেটা যে শুক্রবারই ঘটে যাবে, এমনটা ভাবা যায়নি। মদন মিত্র এ দিন সকলকে চমকে দিয়ে কার্যত প্রথম ওভারেই ‘আউট’ হয়ে গিয়েছেন।

কী ভাবে ঘটল বিষয়টা? সিবিআই অফিসারেরা সময় নিয়ে ধীরেসুস্থে এগিয়েছিলেন মদনের ব্যাপারে। মদনের প্রাক্তন আপ্ত-সহায়ক বাপি করিমকে জেরার পরেই পরিবহণমন্ত্রী বিপদের আঁচ পেয়ে যান। তার পরই পুজোর মুখে তিনি দ্রুত ভর্তি হয়ে যান একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে। মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠরা তখন বলাবলি করেছিলেন, এ হল ‘প্যানিক অ্যাটাক’। সিবিআই তাঁকে সত্যি সত্যিই সমন পাঠায় তারও বেশ কিছু দিন পর, ১৪ নভেম্বর। ফের হাসপাতালে ভর্তি হন মদন। সিবিআই কিন্তু কোনও তাড়াহুড়ো করেনি। মন্ত্রী বাড়ি ফিরে আসার পরে সপ্তাহ দুয়েক সময় নিয়ে তারা দ্বিতীয় সমন পাঠায়। বিশ্বস্ত সূত্রের খবর মদনও বুঝে যান, আর এড়ানোর পথ নেই।

এ দিন সকাল ১১টা নাগাদ সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে সিবিআই দফতরে শালমুড়ি দিয়ে হাজির হন মদন। সিবিআই অফিসারদের একাংশ জানিয়েছেন, মোট ৪২টি আর্থিক কেলেঙ্কারি সংক্রান্ত প্রশ্ন তৈরি ছিল মদনের জন্য। কী কী প্রশ্ন করা হবে, তা নিয়ে শুক্রবার সকালেও একপ্রস্ত আলোচনা করেন অফিসারেরা। তাঁদের হাতে ছিল, মদনবাবুর প্রাক্তন আপ্ত-সহায়ক বাপি করিম এবং ঘনিষ্ঠ অনুগামী প্রশান্ত প্রামাণিকের বয়ান। সারদার দুই গাড়িচালক এবং দুই হিসাবরক্ষকও জবানবন্দি দিয়ে জানিয়েছিলেন, তাঁদের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে টাকার। সেখানেও মদনবাবুর নাম ছিল। ওই জবানবন্দি এ দিন মদনবাবুর সামনে রাখা হয়। দেখানো হয় কয়েকটি ‘ভিডিও ক্লিপিং’-ও।

সিবিআই সূত্রের খবর, প্রথমে সব প্রশ্নের জবাবেই ‘কিছু জানি না’ বলছিলেন মদনবাবু। মদনের ঘনিষ্ঠ মহলের মতে, মন্ত্রী তেমনটাই ঠিক করে গিয়েছিলেন। গোয়েন্দারা যা-ই প্রশ্ন করুন, তিনি ‘জানি না’ বলবেন, এমনই পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সিবিআই বিভিন্ন তথ্য নিয়ে এ দিন যে ভাবে মদনবাবুকে চেপে ধরে, তাতে দৃশ্যতই ওই কৌশল শেষ পর্যন্ত কাজ করেনি।

সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের অভিযোগ ছিল, মদনবাবু একাধিক বার চাপ দিয়ে তাঁর কাছ থেকে নগদ টাকা নিয়েছেন। মাঝেমধ্যেই রাতে মদনবাবু সারদার মিডল্যান্ড পার্ক অফিসে এসে নগদ টাকা নিয়ে যেতেন বলে তাঁর দাবি। অভিযোগ, মদনবাবুর ভবানীপুর ও কামারহাটির বাড়িতে সুদীপ্তর দুই গাড়িচালকও টাকা পৌঁছে দিতেন। সুদীপ্ত সিবিআই-এর কাছে দাবি করেছেন, সারদার টাকায় মদনবাবু দুটি গাড়িও নিয়েছেন।

সিবিআই সুদীপ্তর গাড়িচালকদের জবানবন্দি মদনবাবুর সামনে রাখার পাশাপাশি, এক জন চালককেও এ দিন দফতরে বসিয়ে রেখেছিল। মদনবাবু যখন ওই সব তথ্য ‘মিথ্যা’ বলে বাঁচার চেষ্টা চালাচ্ছেন, তখন ওই চালককে তাঁর মুখোমুখি এনে দেন তদন্তকারীরা। সিবিআইয়ের এক তদন্তকারী বলেন, “তখনই মদনবাবুর চেহারা বদলে যায়।” এর পর কফিনে শেষ পেরেক সিবিআই মদনবাবুর সামনে হাজির করে সুদীপ্ত সেনের আইনজীবী নরেশ ভালোড়িয়াকে। সিবিআইয়ের অভিযোগ, সারদার সঙ্গে মদনবাবুর কয়েকটি আর্থিক লেনদেনের সময় নরেশ জড়িত ছিলেন। মাসখানেক আগে সিবিআই জেরার মুখে নরেশ পরিবহণমন্ত্রী সম্পর্কে নানা তথ্য দিয়েছিলেন বলেও তদন্তকারীদের দাবি। এ দিন নরেশকে সামনে রেখে সেই সব লেনদেনের কথা জানতে চায় সিবিআই। সিবিআইয়ের এক কর্তার দাবি, “মদনবাবু আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছুই বলতে পারেননি।” বেআইনি আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে এ দিন নরেশকেও পরে গ্রেফতার করে সিবিআই।

সিবিআইয়ের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ভেঙে পড়ার আগে শেষ বার চালকদের জবানবন্দিকে ‘ভাড়াটে সাক্ষীর বয়ান’ বলে চালানোর চেষ্টা করেছিলেন মদনবাবু। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। গোয়েন্দারা একের পর এক তথ্য হাজির করে যে সব প্রশ্ন করতে থাকেন, তার কোনও জবাব দিতে পারেননি তিনি। মদনবাবু যে এত সহজে হাল ছাড়বেন, সেটা সিবিআইও আশা করেনি। এর আগে রজত মজুমদার ও সৃঞ্জয় বসুকে গ্রেফতারের আগে তাঁদের একাধিক বার জেরা করেছিলেন তদন্তকারীরা। আগে থেকে দিল্লির সদর দফতরের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁদের গ্রেফতারের দিন ঠিক করা ছিল। সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, মদনবাবুর ক্ষেত্রে এ দিন সে রকম কোনও প্রস্তুতি ছিল না। সিবিআইয়ের এক কর্তা স্বীকার করছেন, “আমরা ভেবেছিলাম, মদনবাবুকে আরও কয়েক বার জেরা করতে হবে। তিনি যে এত দ্রুত এ ভাবে ভেঙে পড়বেন, ভাবিনি।”

স্নায়ুর লড়াইয়ে হার মেনে মদনবাবু এ দিন হড়হড় করে নানা তথ্য উগরে দিয়েছেন বলেও সিবিআই সূত্রের খবর। তাতে কিছুটা অবাকই হয়েছেন তদন্তকারীরা। কিন্তু এর পরে মন্ত্রীকে গ্রেফতার করা ছাড়া পথ ছিল না বলেই জানাচ্ছেন তাঁরা। বেলা ২টো নাগাদ সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্স থেকে ফোন করা হল দিল্লির সিবিআই সদর দফতরে। বলা হল, মদনবাবুকে হেফাজতে নেওয়া দরকার। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে গেল মন্ত্রীকে গ্রেফতারের সবুজ সঙ্কেত।

কেন এত চটপট হার মানলেন মদনবাবুর মতো পোড় খাওয়া নেতা?

একাধিক ব্যাখ্যা মিলছে মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে। কেউ মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের কথা থেকেই একটা সূত্র খুঁজে পাচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী এ দিন মদনের ‘হড়বড়ে স্বভাবে’র কথা উল্লেখ করেছেন। কারও কারও আশঙ্কা, সেই ‘হড়বড়ানি’ই ডুবিয়ে থাকতে পারে জনপ্রিয় ‘মদনদা’কে। আর একটি ব্যাখ্যা, চিকিৎসকেরা মদনের শরীরে বড় ধরনের রোগ খুঁজে পাননি ঠিকই। কিন্তু মন্ত্রীর শরীরগতিক সামগ্রিক ভাবে খুব ভাল যাচ্ছিল না। গ্রেফতারির আশঙ্কা তাঁর মনকেও দুর্বল করে দিচ্ছিল। সব মিলিয়ে খুব চাপের মধ্যেই ছিলেন মদন। আর সিবিআই সূত্রে যা জানা যাচ্ছে, গোয়েন্দারা যে ভাবে পরপর তথ্য সাজিয়েছিলেন, তার ফাঁক গলে বেরনো সম্ভব ছিল না। লড়াইটা এ ভাবে জেতা যাবে না বুঝেই মদন আর প্রক্রিয়াটিকে দীর্ঘায়িত করার মতো মনের জোর বা যুক্তির আশ্রয়, কোনওটাই খুঁজে পাননি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement