ফিরিয়ে দাও মদনগোপাল, শুনলেন কি ঘুমভাঙা দেবতা

শীতের বারবেলা। সকালের পুজোপাঠ সাঙ্গ হয়ে মন্দিরের দুয়ার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ মস্ত গোলযোগ। ক্যাঁচ করে দরজা খুলে যায়। বাইরে হেলে পড়া রোদ ঠিকরে বিগ্রহের চোখে লাগে। পুজোর তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় ফের। ভরদুপুরে আর ফুল-বেলপাতা জোগাড় হয়নি। তবে পতাকায় দিব্যি লটপট করছে জোড়াফুল। থালায় ঘিয়ের লাড্ডু।

Advertisement

কেদারনাথ ভট্টাচার্য

কালনা শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:১৫
Share:

কালনার মদনগোপাল মন্দিরে পুজো দিলেন টিএমসিপি সমর্থকরা। ছবি: মধুমিতা মজুমদার

শীতের বারবেলা।

Advertisement

সকালের পুজোপাঠ সাঙ্গ হয়ে মন্দিরের দুয়ার বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

হঠাৎ মস্ত গোলযোগ। ক্যাঁচ করে দরজা খুলে যায়। বাইরে হেলে পড়া রোদ ঠিকরে বিগ্রহের চোখে লাগে। পুজোর তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় ফের। ভরদুপুরে আর ফুল-বেলপাতা জোগাড় হয়নি। তবে পতাকায় দিব্যি লটপট করছে জোড়াফুল। থালায় ঘিয়ের লাড্ডু।

Advertisement

ভক্তদের মধ্যমণি সদ্য তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য সহ-সভাপতি পদে বসা সন্দীপ বসু কালনা শহরেরই ছেলে। ইদানীং বেশি সময় কাটে কলকাতায়। সোমবার রাতে তিনি বাড়ি ফিরতেই চাঙ্গা হয়ে উঠেছে ছেলেপুলেরা। কেন মদন মিত্রকে ধরা হল, সেই প্রশ্ন তুলে মঙ্গলবার বারোটা বাজতেই কালনা কলেজে সিবিআই-এর মুণ্ডপাত শুরু হয়। পোড়ে অমিত শাহের কুশপুতুল। কয়েক জন বলাবলি করতে থাকেন, “একটু পরেই তো দাদাকে কোর্টে তুলবে। কে জানে, জামিন হবে কি না!” দু’তিন জন বাতলে দেন, “এ সবে হবে না! দাদা যাতে নিরাপদে ফিরতে পারে তার জন্য মদনগোপালের দ্বারে হত্যে দিতে হবে।”

ব্যস! বেলা দেড়টা নাগাদ কলেজ থেকেই খান বিশেক মোটরবাইকে রওনা হয়ে যান জনা পঞ্চাশ। সবার আগে সন্দীপ। সঙ্গে জেলার কার্যকরী সভাপতি শেখ নইম আলি, কালনা শহর সভাপতি সৌরভ হালদার, কালনা ১ ব্লক সভাপতি মঙ্গল দাস। ১০৮ শিবমন্দির পিছনে ফেলে সরু গলি গিয়েছে মদনগোপাল জিউ মন্দিরে। কিন্তু গ্রিলের ফটকে যে তালা ঝুলছে! নেতারা ছুটলেন পাশে পুরোহিত সঞ্জু গোস্বামীর বাড়িতে। তিনি তখন সবে নেয়ে উঠে মুখে দু’টো ভাত দেবেন।

ভক্তেরা আব্দার করেন ‘মন্দির খুলতে হবে ঠাকুরমশাই। পুজো হবে।’ পুরোহিত অবাক। বলেন, ‘সে তো সকালেই হয়ে গিয়েছে। ঠাকুর বিশ্রাম করছেন।’ ‘আবার এক বার হবে। জরুরি দরকার।’ আব্দার ফেলতে পারেননি ষাটোর্ধ্ব সঞ্জুবাবু। পুজোর ধুতি পরে, ঘিয়ে রঙা উত্তরীয় চাপিয়ে রওনা দেন মন্দিরে। নেতারা হাঁক পাড়েন, ‘ভোগে কী দিবি রে?’ সঙ্গে সঙ্গে মোটরবাইক স্টার্ট নেয়। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আসে লাড্ডু।

তত ক্ষণে মন্দিরের চাতালে হাত জোড় করে বসে পড়েছেন টিএমসিপি নেতা-কর্মীরা। ঘণ্টা নাড়তে-নাড়তেই পুরোহিত হাঁক পাড়েন, ‘কার নামে সঙ্কল্প হবে?’ পিছন থেকে জবাব আসে ‘মদনগোপাল মিত্র।’ ‘গোত্র কী?’ নেতারা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকেন। পুরোহিত একটু থমকে থেকে ফের ঘণ্টা নাড়তে শুরু করেন। বেলা দু’টো নাগাদ পুজো শেষ হয়। ঘরে ফেরার আগে ঠাকুরমশাই বলে যান, “ছেলেরা কিছু বলতে না পারলেও আলিম্মান গোত্র ধরে পুজো করেছি।”

কাঁচা ঘুম ভাঙালে ঠাকুর রুষ্ট হন না? পুরোহিত বলেন, “দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু বিশেষ প্রয়োজনে ওরা পুজো দিতে চাইল বলেই ফের পুজো দিলাম। দেবতা তো সবার।” বেলা গড়াতেই জানা যায়, আলিপুর আদালতে মদন মিত্রের জামিন হয়নি। তবে কি দেবতা কথা শুনলেন না? হিতে বিপরীত হল?

নবদ্বীপের মদনমোহন মন্দিরের সেবাইত নিত্যগোপাল গোস্বামীর মতে, “শয়নের পরে বিগ্রহের ঘুম নির্দিষ্ট সময়ের আগে ভাঙানো যায় না। অসময়ে জাগালে মানুষ কূপিত হন, ভগবানও ব্যতিক্রম নন। এতে উপকারের চেয়ে অপকার হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি।” কোচবিহারে মদনমোহন মন্দিরের পুরোহিত হীরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যও বলেন, “ঠাকুর বিশ্রামে গেলে কোনও পুজোর নিয়ম নেই।” কালীঘাট মন্দিরের প্রধান শাস্ত্রীয় উপদেশক শান্তিপদ ভট্টাচার্য, কৃত্যতীর্থ ঋত্বিক শাস্ত্রীর ব্যাখ্যা, “পুজো মানে আত্মবৎ সেবা। ঘুম ভাঙালে আমি কি খুশি হব? চির দিন যা হয়ে এসেছে তা-ই আচাররূপী ধর্ম। এটা তো শিষ্টাচারবিরোধী।”

কপালের ফেরই বলতে হবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন