বিদ্রোহীদের ঠেকাতে কড়া দাওয়াই ছেড়ে নরম সুর নিয়েছেন সদ্যই। আলোচনার পথে দলের মধ্যে সমস্যা মেটাতে আবেদন জানিয়েছেন। বিক্ষুব্ধদের মধ্যে অনেককে সামনে উপনির্বাচনের দায়িত্ব দিয়ে বেঁধেও ফেলেছেন। তবু মনে মনে আশঙ্কার কালো মেঘ দেখছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! কলকাতা-সহ রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ পুরসভার ভোটে দলে অন্তর্ঘাতের আতঙ্ক এখন চিন্তায় ফেলে দিয়েছে তৃণমূল নেত্রীকে।
মমতার জমানায় এমনিতে পঞ্চায়েত বা পুরসভার কোন ভোট কখন হবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই! মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়া ১০টি পুরসভার ভোট যেমন ৩১ জানুয়ারির মধ্যে হওয়ার কথা থাকলেও ক্যালেন্ডারের পাতা ফেব্রুয়ারিতে গড়িয়ে গিয়েছে। ভোটের দেখা নেই! এর পরে মে-জুন মাসে কলকাতা ও বিধাননগর-সহ ৮১টি পুরসভার মেয়াদ ফুরোবে। সেই ৮১ পুরসভার সঙ্গে বকেয়া ১০টির ভোট একসঙ্গে করা যায় কি না, তা নিয়ে শাসক দলের অন্দরে নানা অঙ্ক কষা চলছিলই। সম্ভাব্য সময়ও ভাবা হচ্ছিল এপ্রিলে। কিন্তু এখন আবার নতুন উপদ্রবের মতো জুড়ে বসেছে অন্তর্ঘাতের আতঙ্ক! পুরসভাগুলির মধ্যে কলকাতা এবং মহানগর লাগোয়া বিধাননগরকে নিয়েই রাজনৈতিক চাঞ্চল্য বেশি। আবার সেই দুই পুর-এলাকাতেই বিজেপি-র দাপট দ্রুত বাড়ছে। তৃণমূল নেত্রীর আশঙ্কা, মুখে দলের যে যেমনই দাবি করুন, তলায় তলায় ওই দুই পুরভোটে ‘বিভীষণ’দের আবির্ভাব হতে পারে! তাই কলকাতা এবং বিধাননগর পুরসভার ভোট আলাদা দিনে করার ইঙ্গিত দলকে দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী।
সচরাচর কলকাতা এবং বিধাননগরের ভোট হয় একই দিনে। বাকি পুরসভাগুলির অন্য দিনে। বাম জমানায় প্রায় এটাই ছিল দস্তুর। এ বার সেই ছক ভাঙতে চাইছেন মমতা। শাসক দলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “এতে অসুবিধা কী? সিপিএম-ও আগে এমন জিনিস করেছে। কলকাতা এবং বিধাননগরে আলাদা দিনে ভোট হলে পুলিশ-প্রশাসনের পক্ষে নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করাও সুবিধা হবে।” পুরভোট যে হেতু রাজ্য পুলিশের তত্ত্বাবধানে হবে, তাই নিরাপত্তা ব্যবস্থার সুবিধার মোড়কেই যুক্তি সাজাতে চাইছে শাসক শিবির।
কিন্তু আসল কথা অন্য! লোকসভা ভোটের হিসাব অনুযায়ী, বিধাননগর পুরসভায় বিজেপি-রই রমরমা। কলকাতা পুরসভার ৩১টি ওয়ার্ডে গেরুয়া শিবির এগিয়ে। এর মধ্যে বিধাননগরে আবার দুই বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত ও সুজিত বসুর কোন্দল তুঙ্গে। বিধাননগরের পুর চেয়ারপার্সন, মমতা-ঘনিষ্ঠ কৃষ্ণা চক্রবর্তীর সঙ্গেও সব্যসাচীর বনিবনা নেই। এমতাবস্থায় অন্তর্ঘাত করে দলের ক্ষতি করেও তাকে ‘বিজেপি-হাওয়া’ বলে চালিয়ে দেওয়া সহজ! ঘরের কাজিয়ার সমস্যা কলকাতা পুরসভাতেও প্রযোজ্য। তাই পৃথক দিনে ভোটের ব্যবস্থা করে তৃণমূল নেতৃত্ব চাইছেন, নিজেদের বিশ্বস্ত বাহিনীকে কলকাতা ও বিধাননগর, দুই পুরসভারই দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে! দলের এক নেতার বক্তব্য, “ঝুঁকি নেওয়ার পরিস্থিতি এখন নেই!”
এমন নয় যে, তৃণমূলে গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব এই প্রথম দেখা দিল! তা হলে এ বারের ভোট নিয়ে এত ভাবনা কেন? দলের রাজ্য নেতার বক্তব্য, “সমস্যা আগেও ছিল। কিন্তু তার চেহারা অন্য হয়েছে। নেতাদের অনেকেই প্রকাশ্যে বিদ্রোহ জানান দিচ্ছেন। এখন তো ঝুঁকি নেওয়া কঠিন!” দলের এই অংশের ইঙ্গিত, সব্যসাচীদের সাম্প্রতিক বিস্ফোরণের দিকে। পাশাপাশিই দলনেত্রীর কপালে চিন্তার ভাঁজ বহু গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছেন মুকুল ‘সত্যান্বেষী’ রায়, প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের দাবি তুলে যিনি কার্যত দলনেত্রীকেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন! অন্য বার ভোটের রণকৌশলের নিপুণ খেলোয়াড় হিসাবে মুকুল থাকেন। এ বার তাঁর অবস্থানই গোলমেলে! মুকুল-শিবির কী ভূমিকা নেবে, পুরভোটে তা-ও বিরাট চিন্তা তৃণমূল নেতৃত্বের কাছে। এ সব আশঙ্কা থেকেই কলকাতা ও বিধাননগরের মতো ‘মর্যাদার লড়াই’ আলাদা দিনে ফেলার ভাবনা।
এমন পরিকল্পনা অবশ্য এখনও সরকারি স্তরে পৌঁছয়নি। যাবতীয় অঙ্ক রয়েছে রাজনৈতিক স্তরেই। এমনকী, শেষ পর্যন্ত এই পরিকল্পনাই বহাল থাকবে, তার নিশ্চয়তা নেই! দলনেত্রীর মনোভাব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তৃণমূলের এক নেতার কথায়, “যে বিক্ষুব্ধদের নিয়ে দলীয় নেতৃত্বের আশঙ্কা, পুরভোটের আগেই তাঁরা দল ছেড়ে দিলে তো আবার খেলাই উল্টে যাবে! তখন বিজেপি-কে বেগ দিতে বরং এক দিনে ভোটেই সুবিধা!”
সঙ্কট-কালে সবেতেই এখন শাসকের উভয় সঙ্কট!