জমি বিক্রির প্রকল্প মারফত রোজ ভ্যালি বাজার থেকে যে টাকা তুলেছে, সেটাই তারা গোষ্ঠীর অন্যান্য সংস্থাকে ঋণ হিসেবে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) সূত্রে শুক্রবার এমনই দাবি করা হয়েছে। ইডি-র অভিযোগ, ওই টাকা রোজ ভ্যালির বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে যখন ঘোরানো হচ্ছে, তখন ব্যালান্স শিটে দেখানো হয়েছে যে, জমি বিক্রি প্রকল্পের মূল সংস্থাটি চলছে বিপুল লোকসানে!
এবং এটা অর্থ তছরূপেরই রকমফের ছাড়া অন্য কিছু নয় বলে মনে করছেন ইডি-কর্তারা। যদিও সংস্থা কর্তৃপক্ষের তরফে তা মানতে চাওয়া হয়নি।
ইডি-তদন্তে প্রকাশ, রোজ ভ্যালির ব্যবসার শুরু ২০০০ সালে। কারবারের আয়তন বাড়তে শুরু করে ২০০৫-এ। রোজ ভ্যালির অধীনে অনুমোদিত সংস্থা ৩১টি। প্রতিটি হাজার টাকা মূল্যের প্রায় ১ লক্ষ ঋণপত্র বাজারে ছেড়েছিল রোজ ভ্যালি। কিন্তু সে জন্য সেবি-র যে অনুমতি লাগে, রোজ ভ্যালির তা ছিল না বলে ইডি’র অভিযোগ। তদন্তে প্রকাশ, ঋণপত্র সংক্রান্ত অনিয়মের অভিযোগে সল্টলেকের এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা রোজ ভ্যালির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিল। পরে সেবি-ও তদন্তে নামে।
এই পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ত্রিপুরা-অসম-ওড়িশায় রোজ ভ্যালির বিরুদ্ধে দাখিল অভিযোগগুলির কাগজপত্র ইডি চেয়ে পাঠাচ্ছে। গত বছর ঝাড়খণ্ডের ঘাটশিলা ও রাজমহলে সংস্থার অফিস পুলিশ সিল করে দিয়েছিল। ঝাড়খণ্ড পুলিশের থেকে সে ব্যাপারে নথি চাওয়া হবে। এ দিন ইডি-সূত্রের বলা হয়, ওই তিন রাজ্যে রোজ ভ্যালির কাজ সম্পর্কে কী কী অভিযোগ রয়েছে, তা জানতে পারলে পশ্চিমবঙ্গে তদন্তে সুবিধা হবে।
ইডির দাবি: রোজ ভ্যালির বিভিন্ন সংস্থা একে অপরকে ঋণ দিয়ে কারচুপির পথ খুলেছে। তদন্তকারীদের অভিযোগ, চেয়ারম্যান গৌতমবাবু নিজেই গোষ্ঠীর এক কোম্পানি থেকে প্রায় ২০৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন, যখন মূল সংস্থা ৪৬৮ কোটি টাকা ক্ষতিতে চলছিল! ইডি-সূত্রের খবর: রোজ ভ্যালির ২০১১-১২ অর্থবর্ষের ব্যালান্স শিটে বিবিধ খরচ (মিস্লেনিয়াস) খাতে দেখানো হয়েছে প্রায় ৭৮ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবর্ষ পর্যন্ত গোষ্ঠীর বৈদ্যুতিন চ্যানেলের ক্ষতির অঙ্ক প্রায় আড়াইশো কোটি, সংবাদপত্রে ছ’কোটি ছুঁইছুঁই। কোম্পানি বিষয়ক মন্ত্রকে রোজ ভ্যালির পেশ করা তথ্য তুলে ধরে ইডি জানাচ্ছে, ২০০৯-১০ থেকে ২০১২-১৩ অর্থবর্ষে গোষ্ঠীর অধীনস্থ ৩১টি অনুমোদিত কোম্পানির সম্মিলিত লোকসান ছিল ৮০০ কোটি টাকার।
অথচ সেই অবস্থাতেও একাধিক সংস্থাকে ঋণ জোগাতে কসুর করা হয়নি বলে ইডি’র অভিযোগ। এবং তদন্তকারীদের দাবি, ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রেও অনিয়ম হয়েছে। সংস্থা-কর্তৃপক্ষের কী বক্তব্য?
ইডি’র তোলা অভিযোগগুলির কয়েকটি স্বীকার করলেও নিজে টাকা ধার নেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন রোজ ভ্যালির চেয়ারম্যান গৌতম কুণ্ডু। তিনি বলেন, “আমাদের গোষ্ঠীর কিছু সংস্থা লোকসানে চলছে। যেমন টিভি চ্যানেল, পত্রিকা ইত্যাদি। আমাদের অন্য সংস্থা থেকে তাদের ঋণ দেওয়া হয়েছে। সে বাবদ সুদও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমি নিজে ঋণ নিয়েছি এই অভিযোগ অসত্য।”
তবে বাজারে ঋণপত্র ছেড়ে টাকা তোলার কথা গৌতমবাবু স্বীকার করেছেন। কবুল করেছেন, এর জন্য তাঁর কাছে সেবি’র অনুমোদন ছিল না। তা হলে ঋণপত্র ছাড়লেন কেন?
গৌতমবাবুর ব্যাখ্যা, “২০০৩-এ আমরা বাজারে ঋণপত্র ছেড়ে পাঁচ বছরের মেয়াদে ১২ কোটি টাকা তুলেছিলাম। মেয়াদ শেষে সমস্ত টাকা লগ্নিকারীদের ফিরিয়ে দিয়েছি।” গৌতমবাবু জানান, ওই প্রকল্প নিয়ে ২০১০-এ সেবি তাঁদের নোটিস পাঠায়, যা চ্যালেঞ্জ করে তাঁরা কলকাতা হাইকোর্টে যান। আদালত রোজ ভ্যালিকে ১ কোটি টাকা জরিমানা করে। “এর পরে সিকিউরিটিজ অ্যাপিলেট ট্রাইবুনাল (স্যাট)-এ যাই। স্যাট জরিমানার অঙ্ক ১০ লক্ষে নামিয়ে আনে। তা আমরা মিটিয়েও দিয়েছি।” বলেন রোজ ভ্যালি কর্ণধার। তাঁর দাবি, ইডি এখন ওই ব্যাপারটা নিয়েই তদন্ত করছে।
গোষ্ঠীর বিভিন্ন কোম্পানির ‘লোকসান’ প্রসঙ্গে গৌতমবাবুর বক্তব্য, “আমাদের কোন কোম্পানিতে কত লাভবা ক্ষতি হয়েছে, তার বিবরণ ব্যালান্স শিটেই রয়েছে। ব্যালান্স শিট আমরা ইডি’র হাতে তুলে দিয়েছি।”
গৌতমবাবুর দাবি, তদন্তের প্রতিটি ধাপে তাঁরা পূণর্র্ সহযোগিতা করছেন। “রোজ ভ্যালির উদ্দেশ্যই হল লগ্নিকারীদের টাকা দেওয়া। এখন পর্যন্ত অভিযোগ ছাড়াই আমরা সেই কাজ করে চলেছি।” এ দিন এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন তিনি। সমস্ত লগ্নিকারীর টাকা ফেরানোর ব্যাপারে তাঁরা আত্মবিশ্বাসী বলেও ঘোষণা করেছেন রোজ ভ্যালি-চেয়ারম্যান।