পশ্চিমবঙ্গকে ‘ব্যর্থ রাজ্য’ আখ্যা দিলেন বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ। এহেন পর্যবেক্ষণের কারণ ব্যাখ্যা করে দেশের প্রথম সারির এই বিজ্ঞানী এ দিন বললেন, “এখানে সব সময় কোনও না কোনও বিষয়ে শুধু আন্দোলনই হয়, কোনও শান্তি নেই।”
ঘটনাচক্রে এ দিনই সিপিএমের বাংলা মুখপত্রের প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মন্তব্য করেছেন যে, তৃণমূল কংগ্রেসের আর সরকার চালানোর কোনও নৈতিক অধিকার নেই। তার কারণ হিসেবে শাসক দলের বিরুদ্ধে রাজ্যকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগই এনেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “কেউ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন না, ভাল আছি। রাজ্যে সমাজবিরোধীদের নরক চলছে।”
রাজনীতিক হিসেবে বুদ্ধবাবু তাঁর দলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূলের শাসনকে আক্রমণ করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শিক্ষাবিদ বিকাশবাবুর মন্তব্য রাজনৈতিক তথা প্রশাসনিক মহলে ঝড় তুলেছে। তাঁর আক্রমণের কারণ ব্যাখা করে বিকাশবাবু এ দিন বলেন, “রাজ্যের বাইরে দীর্ঘদিন কাটানোর পরে ১৯৮৪ সালে আমি কলকাতায় ফিরি। কিন্তু যা দেখছি, চরম হতাশা ও ব্যথা নিয়েই এ কথা বলছি।”
২০১০ সালে ‘পদ্মভূষণ’ সম্মান পাওয়া বিকাশবাবু সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের প্রাক্তন অধিকর্তা। এবং এই সে দিনও ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টারের ‘হোমি ভাবা অধ্যাপক’ হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। পরমাণু গবেষণা এবং বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের প্রশাসক হিসেবে বিকাশবাবু দেশে-বিদেশে সমান ভাবে সমাদৃত। পার্থ চট্টোপাধ্যায় শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পর তাঁকে সিলেবাস কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করেছেন। সেই বিকাশবাবুই এ দিন যা বলেছেন, তাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের বিব্রত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে বলেই মনে করা হচ্ছে। যার ইঙ্গিত দিয়ে এ দিন বিকাশবাবুর মন্তব্য সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া এড়িয়ে গিয়েছেন পার্থবাবু। তিনি বলেছেন, “বিকাশবাবুর সঙ্গে কথা না বলে আমি এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করব না।”
শনিবার কলকাতায় শ্রীশিক্ষায়তন স্কুলের হীরক জয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ দেন বিকাশবাবু। ওই অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রেসিডেন্সির সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলাম। ওই দুই প্রতিষ্ঠানে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি চলছে, তা নিয়ে কিছু বলে আমি আর আপনাদের সময় নষ্ট করতে চাই না।” বস্তুত, সামগ্রিক ভাবে গোটা রাজ্যের শিক্ষা পরিস্থিতি নিয়েই এ দিন অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বিকাশবাবু। দুষেছেন ছাত্র ও শিক্ষক দুই মহলকেই। শিক্ষকদের প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য, “বাংলায় অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকাই কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েও তাঁরা আসলে রাজনৈতিক দলের দাদা।”
পাশাপাশি, বর্তমান ছাত্র আন্দোলন প্রসঙ্গে বিকাশবাবুর বক্তব্য, “অনেক সময়ই আমি বিস্মিত হই, কী হচ্ছে এখানে! সারাক্ষণ চলবে না, চলবে না এ সব আবার কী! আসলে কিছুই তো চলছে না। ওরা কি সেটাই বারবার বলতে চাইছে!” তাঁর সাফ কথা, “কলেজে কলেজে দাদাগিরি চলছে। এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক। শুধু আন্দোলনের জন্যই পড়াশোনা কার্যত লাটে উঠেছে।” আগামী প্রজন্মের উদ্দেশে তাঁর পরামর্শ, এখনকার যুব সমাজকে বুঝতে হবে, শুধু আন্দোলন এই প্রতিযোগিতার বাজারে তাঁদের এগিয়ে নিয়ে যাবে না।
সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, এক দিকে শিক্ষকদের রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং ছাত্রদের নির্বোধের মতো আন্দোলনই যে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে অরাজকতা তৈরি করেছে, তা প্রকারান্তরে বলতে চেয়েছেন এই প্রবীণ বিজ্ঞানী। যদিও পার্থবাবুর মতে, “ছাত্র আন্দোলন নিয়ে যে সব প্রচার চলছে, তা সর্বৈব মিথ্যা। রাজ্যে ৫০০টি কলেজ রয়েছে। তার ৫১টিতে ভোট চলছে। তার মধ্যে মাত্র আটটিতে গোলমাল হয়েছে।”
বিকাশবাবু যে দিন শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য নিয়ে সরব হয়েছেন, সে দিন মূলত দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতা নিয়েই রাজ্য সরকারকে বিঁধেছেন বুদ্ধবাবু। সারদা প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, এ রাজ্যে এর আগে মন্ত্রী থাকাকালীন কেউ জেলে যাননি। শুধু তা-ই নয়, এই দুর্নীতিতে তৃণমূলের একের পর এক নেতা, সাংসদ গ্রেফতার হচ্ছেন। বুদ্ধবাবুর প্রশ্ন, “এর পর এদের সরকার চালানোর আর কোনও নৈতিক অধিকার আছে? সবাই বুঝতে পারছে, এই সরকার আর বেশি দিন টিকতে পারবে না।”
২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে বামেদের ভরাডুবির পরে বুদ্ধবাবুর মুখ্যমন্ত্রী থাকার নৈতিক অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল তৎকালীন বিরোধী দল তৃণমূল। তার আরও দু’বছর ক্ষমতায় থাকলেও কার্যত অচল হয়ে গিয়েছিল বুদ্ধবাবুর সরকার। সারদা দুর্নীতি নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারও এখন প্রায় সেই পথেই হাঁটতে চলেছে বলেই অনেকের মত। আর তাই এখন সেই অস্ত্রেই মমতার সরকারকে বিঁধতে শুরু করেছে সিপিএম থেকে শুরু করে কংগ্রেস, বিজেপি। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, মহিলাদের নিরাপত্তা, বেকারদের কর্মসংস্থানের প্রসঙ্গ তুলে এ দিন বুদ্ধবাবু বলেন, “তৃণমূলের সাড়ে তিন বছরে রাজ্য দশ বছর পিছিয়ে গিয়েছে। মানুষ এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চাইছেন।”
রাজ্য জুড়ে নৈরাশ্যের আবহই এ দিন মিলিয়ে দিল শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিককে।