নিন্দা দূর অস্ত্, রাজ্যের মন্ত্রীরা বামেদের জাঠায় হামলা নিয়ে লাগাতার কটাক্ষ-বিদ্রূপ করছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বিরোধী দলের উপর একের পর এক হামলায় এখনও প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেননি। এমতাবস্থায় বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র-সহ বর্তমান ও প্রাক্তন বাম বিধায়কদের জাঠায় শাসক দলের হামলার সমালোচনা করলেন বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়।
সিপিএমের আনিসুর রহমানের নেতৃত্বে জনাকুড়ি বাম বিধায়ক মঙ্গলবার স্পিকার বিমানবাবুর সঙ্গে দেখা করে বিরোধীদের উপরে হামলার ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এর আগে হাওড়ায় ত্রাণ শিবিরে যাওয়ার পথে সূর্যবাবুকে তৃণমূলের বাধা দেওয়া এবং সন্দেশখালিতে মিছিল করতে গিয়ে সিপিএম বিধায়ক নিরাপদ সর্দারের উপরে শাসক দলের হামলার অভিযোগ নিয়েও বাম পরিষদীয় দল স্পিকারের দ্বারস্থ হয়েছিল। অল্প সময়ের ব্যবধানে তিন বার বিরোধীদের কাছে একই রকমের উদ্বেগ শোনার পরে এ দিন মুখ খুলেছেন স্পিকার। তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে শাসক দলের মন্ত্রী-নেতাদের মন্তব্য সম্পূর্ণ বিপরীত হচ্ছে বুঝেও স্পিকার বিমানবাবু স্পষ্টই বলেছেন, ‘‘কোনও রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতেই বাধা দেওয়া বা হামলা করা বাঞ্ছনীয় নয়। এখন যে সব ঘটনা ঘটছে, তার নিন্দা করছি।’’
তবে গণতন্ত্রে বিরোধীদের উপরে আক্রমণ বাঞ্ছনীয় নয় বোঝাতে গিয়ে আগের জমানার কিছু ঘটনার দৃষ্টান্তও উল্লেখ করেছেন স্পিকার বিমানবাবু। বিধানসভায় নিজের ঘরে এ দিন তিনি বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (তৎকালীন বিরোধী দলনেতা) উপরে যে হামলা হয়েছিল, তারও নিন্দা করেছি।’’ তখন অবশ্য বিমানবাবুর পরিচিতি ছিল আইনজীবী-নেতা হিসাবেই।
এর আগে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বা পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম কেউই বামেদের উপরে হামলার নিন্দা বা ন্যূনতম উষ্মাও প্রকাশ করেননি। উল্টে জাঠার নাম করে বামেরা জোর করে গ্রাম দখলের চেষ্টা করছে বলে পার্থবাবু অভিযোগ করেছিলেন। ‘বামেরা জাঠা আক্রান্ত হওয়ার নাটক করছে’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন ফিরহাদ। এখন নিজেদের ‘আক্রান্ত বলা ফ্যাশন’ হয়ে গিয়েছে, এমনও বলেছিলেন পুরমন্ত্রী! শাসক শিবিরের এমন প্রতিক্রিয়ার আবহে কী ভাবে বিমানবাবু এমন মন্তব্য করলেন, তা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে বিভিন্ন শিবিরে। স্পিকার অবশ্য বলেছেন, ‘‘যে যা বলেছেন, তা তাঁদের নিজস্ব বক্তব্য।’’ বিরোধী শিবিরের বিধায়কদের কারও কারও মতে, মন্ত্রীদের মন্তব্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে বুঝে স্পিকারের মাধ্যমে সমালোচনার সুর সামনে এসেছে মুখ্যমন্ত্রীর সবুজ সঙ্কেত নিয়েই।
বিমানবাবুর বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় এ দিন বলেছেন, ‘‘স্পিকারের মন্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী হয়েছে। গণতন্ত্রে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা কখনওই কাম্য নয়।’’ কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার কথায়, ‘‘স্পিকার বিরোধীদের উপরে হামলার নিন্দা করেছেন শুনে খুশি হলাম।’’
জাঠায় তৃণমূলের হামলায় সূর্যবাবু-সহ তিন বিধায়ক আক্রান্ত হওয়ার প্রতিবাদে এ দিন বাম বিধায়কেরা স্পিকারের কাছে লিখিত বক্তব্য জমা দিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, স্পিকারই যে হেতু বিধায়কদের অভিভাবক, তাই তাঁদের অধিকার ও সম্মান রক্ষার্থে আইনগত ব্যবস্থা তাঁকেই নিতে হবে। সরাসরি স্পিকার কোনও আশ্বাস না দিলেও বিষয়টি নিয়ে তিনি স্বরাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে কথা বলবেন বলে বিধায়কদের জানিয়েছেন। পরে সিপিএম বিধায়ক রামেশ্বর দোলই বলেন, ‘‘স্পিকার এই আক্রমণের নিন্দা করে বলেছেন, তিনি কোনও ভাবেই এই ধরনের ঘটনা সমর্থন করেন না। তিনি এ ব্যাপারে রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে কথা বলবেন বলেও জানান।’’ তবে বিধানসভা চত্বরের বাইরের কোনও বিধায়কের সঙ্গে কোনও ঘটনা ঘটলে, সে ব্যাপারে তাঁর ব্যবস্থা নেওয়ার আইনত এক্তিয়ার যে নেই, সে কথাও বাম প্রতিনিধিদের মনে করিয়ে দিয়েছেন স্পিকার। বিধায়ক নিরাপদবাবুর কথায়, ‘‘তবু অভিযোগ জানাতে স্পিকার ছাড়া আমরা আর যাব কোথায়?’’