খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের পরে বর্ধমানে যে জঙ্গি মডিউল বা গোষ্ঠীটির হদিস মিলেছে, পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে বসে তারা অন্তত বছর খানেক ধরে আইইডি (ইম্প্রোভাইজ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) বানিয়ে গিয়েছে এমনটাই মনে করছে এনআইএ।
জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার বক্তব্য, বর্ধমানের উপকণ্ঠে অস্ত্র ও বিস্ফোরকের গবেষণাগার তথা কারখানাটির হদিস ২ অক্টোবর মিলেছে ঠিকই, তবে রাজ্যের অন্য জায়গায় অন্তত এক বছর ধরে ওই একই চক্র আইইডি তৈরি করেছে। এর বেশির ভাগটাই বাংলাদেশে পাচার করা হয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করছে তদন্তকারীরা। শুধু তা-ই নয়, তদন্তকারীরা জেনেছেন, জেহাদি ভাবধারায় এ দেশের এক দল পুরুষ ও মহিলাকে উদ্বুদ্ধ করে বাংলাদেশে নাশকতা ঘটানোর জন্য তাদের দিয়ে মারণাস্ত্র তৈরি করাতে মাসের পর মাস ‘ক্লাস’ নিত ভিনদেশ থেকে আসা কয়েক জন লোক। বিস্ফোরণ-কাণ্ডে ধরা পড়া রাজিয়া বিবি ওরফে রুমি কিংবা আলিমা বিবিদের এমন ভাবে মগজধোলাই করা হয়েছিল যে, ভারতীয় নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তারা অনায়াসেই অন্য দেশে নাশকতা ঘটানোর চক্রান্তে যুক্ত হতে পেরেছিল। গাজা ভূখণ্ডের সাম্প্রতিক সংঘর্ষে প্যালেস্তাইনি শিশুদের উপর ইজরায়েলি হামলার বাছাই করা ভিডিও পর্যন্ত মহিলাদের দেখিয়ে তাদের ‘উদ্বুদ্ধ’ করা হয়েছিল। গোয়েন্দাদের দাবি, ধৃত রাজিয়া ও আলিমা এবং বিস্ফোরণে জখম আব্দুল হাকিমকে জেরা করে এমনই ইঙ্গিত মিলেছে। তা ছাড়া, বর্ধমানের শিমুলিয়া মাদ্রাসা-সহ কয়েকটি সন্দেহজনক জায়গা থেকে মেলা নথিপত্রও একই দিকে ইশারা করছে।
তদন্তকারীদের বক্তব্য, ধৃতদের মুখ থেকে এখনও এই ব্যাপারে সরাসরি কথা বার না-করা গেলেও তাদের জেরা করে বোঝা যাচ্ছে, ২০১২-তে ওই চক্রের সদস্যদের আইইডি তৈরির প্রশিক্ষণ নেওয়ার প্রাথমিক পাঠ শেষ হয়। পরের বছরই তারা পুরোদস্তুর ‘কাজে’ নেমে পড়ে। এক গোয়েন্দা অফিসারের কথায়, “যা মনে হচ্ছে, খাগড়াগড়ে ওই কারখানা বা গবেষণাগার তৈরি হওয়ার বছর খানেক আগেই আইইডি উৎপাদনের ওই রকম অন্তত একটি জায়গা তৈরি করা হয়। আর সেখানে বানানো শ’য়ে শ’য়ে আইইডি এবং অন্যান্য মারণাস্ত্র পাচার করা হয়েছে বাংলাদেশে।” এনআইএ-র এক অফিসারের মতে, “প্রচুর সংখ্যায় আইইডি তৈরির বরাত তাদেরই দেওয়া হবে, যাদের এই ব্যাপারে ভাল রকম অভিজ্ঞতা রয়েছে। কাজেই, নিঃসন্দেহে খাগড়াগড়ে ডেরা বাঁধার অনেক আগেই হাত পাকিয়েছিল শাকিল, সুবহানেরা।”
খাগড়াগড়ের আগে কোথায় তৈরি করা হয়েছিল আইইডি উৎপাদনের সেই কারখানা?
ওই গোয়েন্দা-কর্তা বলেন, “আমরা সেটাই খুঁজে বের করারচেষ্টা করছি। তবে বিশেষ একটিসূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, সম্ভবত মুর্শিদাবাদ জেলায় বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী কোনও জায়গাতেই ওই রকম এক বা একাধিক কারখানা তথা গবেষণাগার গড়ে তোলা হয়েছিল।” ওই কারখানার সম্ভাব্য জায়গা হিসেবে লালগোলা ও বেলডাঙাকে পাখির চোখ করে তল্লাশি চালাচ্ছেন ও খোঁজখবর নিচ্ছেন তদন্তকারীরা।
অন্তত বছর খানেক ধরে এহেন জঙ্গি কার্যকলাপ চললেও সেটা জেলা পুলিশ ও রাজ্য গোয়েন্দা শাখার (আইবি) নজর কী করে এড়িয়ে গেল, সেই প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের অন্দরেই। তাঁদের বক্তব্য, সে ক্ষেত্রে একই ভাবে ব্যর্থ হয়েছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইনটেলিজেন্স ব্যুরো, সেনা গোয়েন্দা ও বিএসএফের গোয়েন্দা শাখাও।
রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষকর্তা অবশ্য বলেন, “জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-সহ বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলা ওই জঙ্গি মডিউল সম্পর্কে আমাদের কাছে খবর ছিল না ঠিকই, তবে বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে সম্প্রতি নদিয়া, মুর্শিদাবাদ ও বাংলাদেশ সীমান্তে আমরা নজরদারি অনেকটা বাড়িয়েছি।” ওই পুলিশ কর্তার কথায়, “আমরা এখনও মনে করি, ওই নজরদারি বাড়ানোর ফলেই মুর্শিদাবাদের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে বোমা তৈরির কারখানা সরিয়ে আনা হয়েছিল বর্ধমানের উপকণ্ঠে।”
ধৃত আব্দুল হাকিম এবং দুই মহিলা রাজিয়া ও আলিমার কাছ থেকেই এই ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলবে বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। তাঁদের দাবি, জেরার সময়ে রাজিয়াকে বার বার প্রশ্ন করা হয়েছে, ভারতীয় নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও কেন সে জেএমবি-র মতো বাংলাদেশি জঙ্গি সংগঠনের কাজে নিজেকে যুক্ত করতে গেল? তদন্তকারীরা জেনেছেন, ধর্মীয় ভাবাবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে ও নিয়মিত মাসোহারার বিনিময়েই তাদের এই বিপজ্জনক কাজে সামিল করা হয়।
এক গোয়েন্দা-অফিসারের কথায়, “রাজিয়া বিবিরা বাংলাদেশি নয়।
তার ঠাকুর্দাও নদিয়ার করিমপুরের বাসিন্দা। এর পরেও রাজিয়া কী করে বাংলাদেশের কোনও জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হল, সেটাই প্রশ্ন।” ওই অফিসার জানান, রাজিয়ার স্বামী, বিস্ফোরণে নিহত শাকিল আহমেদ জেএমবি-র সদস্য বলে প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে। “তবে শুধু স্বামীর সূত্রে নয়, মাসের পর মাস রীতিমতো ক্লাস নিয়ে রাজিয়াদের জেহাদি ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। যার পরিণতিতে নাশকতায় সামিল হওয়ার সময়ে রাজিয়ার মাথায় থাকেনি, সে কোন দেশের নাগরিক,” বলছেন ওই অফিসার।