সভাস্থলে পৌঁছনোর আগে বার বার কথা বলতে দেখা গেল মমতাকে। ছবি: তাপস ঘোষ।
এক জায়গায় রাজ্য জুড়ে উন্নয়নের কথা শোনালেন তিনি।
মিনিট দশেকের মধ্যে অন্য সভায় পাল্টে গেল সুর। আগাগোড়া বেনজির আক্রমণ শানালেন নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে।
নানা প্রান্তে ঝোড়ো প্রচারের মধ্যে সোমবার হুগলির দুই এলাকায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখা গেল দুই রূপে। বলাগড় এবং পাণ্ডুয়া হুগলি লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত এই দু’জায়গায় সভা করেই এ দিন জেলায় নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন তৃণমূল নেত্রী। বলাগড়ে তিনি রাজ্য সরকারের নানা উন্নয়নমূলক কাজের ফিরিস্তি দিয়ে বলেন, “অনেকে গুজরাত মডেলের কথা বলছেন। আসলে এ বার দেশে বাংলাই মডেল হবে। বিশ্ববাংলা হবে।”
কলকাতা থেকে এসেছিলেন হেলিকপ্টারে। ধুলোর ঝড় উড়িয়ে বলাগড়ের জিরাট পাঁচপাড়া ক্লাবের মাঠে মমতার হেলিকপ্টার যখন নামল, তখন বেলা সওয়া ২টো। মাঠেরই এক প্রান্তে সভার আয়োজন করা হয়েছিল। ঠা ঠা রোদের মধ্যেও মাঠ ভরে গিয়েছিল। দর্শক-শ্রোতাদের জন্য অবশ্য ছাউনির ব্যবস্থা ছিল। সুরটা বেঁধে দিয়েছিলেন রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। যে উন্নয়নের কাজ মুখ্যমন্ত্রী তিন বছর ধরে করেছেন, তার কথা তুলে বিনিময়ে দলীয় প্রার্থীদের আশীর্বাদ প্রার্থনা করে তিনি বলেন, “দিল্লিতে তৃণমূলের তিন নম্বর জায়গা অবরাধিত।”
এর পরেই হুগলি কেন্দ্রের দলীয় প্রার্থী রত্না দে নাগ এবং আরামবাগের প্রার্থী আফরিন আলি অপরূপা পোদ্দারকে দু’পাশে নিয়ে রাজ্যের উন্নয়নে একের পর এক প্রকল্পের কথা বলে যান মমতা। কৃষি থেকে শিল্প, কন্যাশ্রী থেকে যুবশ্রী, ব্লকে ব্লকে কিষান মান্ডি থেকে হিমঘর, আইটিআই থেকে ১০০ দিনের কাজের সাফল্য বক্তব্যে সবই ছুঁয়ে যান তিনি।
বলাগড় এমন একটি এলাকা, যেখানে গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের নিরিখে কিছুটা পিছিয়ে তৃণমূল। এখানকার ১৩টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ৮টিই বামেদের দখলে। পঞ্চায়েত সমিতিও হাতছাড়া হয়েছে তৃণমূলের। এ দিন সেই বলাগড়ে দাঁড়িয়ে তৃণমূল নেত্রী বলেন, “বলাগড় কৃষকভাইদের বড় জায়গা। ধান ভাল হয়। চাষিরা এ বার ধানে দাম পেয়েছেন। এখানে সবুজদ্বীপ আছে। আমরা এখানে ইকো-ট্যুরিজম পার্ক করছি। প্রচুর লোকের কর্মসংস্থান হবে।”
মমতা দাবি করেন, “স্বাধীনতার পর থেকে বাম জমানা পর্যন্ত ৬৫ বছরে ৩৮টি কলেজ হয়েছিল। আমরা প্রায় তিন বছরে ৪৫টি কলেজ, ৩৪টি মাল্টি-স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল করেছি। আমাকে যে যা খুশি বলুক। কিন্তু বাংলার অপমান মানব না। অনেকে গুজরাত মডেলের কথা বলছেন। এ বার দেশে বাংলাই মডেল হবে। বিশ্ববাংলা হবে।” কিন্তু উন্নয়নের এই পথে ‘বাম জমানার ঋণের বোঝা’র প্রসঙ্গ তিনি ফের তোলেন। তাঁর কথায়, “আমরা আয় বাড়ালাম। প্রথম বছর ৩২ হাজার কোটি টাকা আয় করেছি। তার পরে ৪০ হাজার কোটি টাকা। সেই আয় থেকেও ওরা (কেন্দ্র) কেটে নিচ্ছে।”
পাণ্ডুয়ায় হেলিকপ্টার দেখতে ভিড়। ছবি: প্রকাশ পাল
উন্নয়নের ফিরিস্তির পরেই তৃণমূল নেত্রী চলে যান বিরোধীদের সমালোচনায়। তিনি বলেন, “কিছু লোক আমাদের উন্নয়ন দেখতে পাচ্ছেন না। তাঁদের কোনও কাজ নেই। টিভিতে কুৎসা রটাচ্ছেন। সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি সব ভাই-ভাই হয়ে গিয়েছে। রাজ্যে ৩৪ বছরে কোনও উন্নয়ন হল না। সেটা ওরা দেখতে পেল না। আমরা তিন বছরে যে উন্নয়ন করলাম, সেটা নিয়ে কুৎসা?”
বলাগড়ে মমতা ছিলেন ঘণ্টাখানেক। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে তিনি উড়ে যান পাণ্ডুয়ায়। চারটের কিছু আগে পাণ্ডুয়ার কলবাজারের কাছে তাঁর হেলিকপ্টার যখন নামছে, তখনই বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ‘ব্রেকিং নিউজ’-এ দেখানো শুরু হয়ে যায় ‘পাঁচ জেলার পুলিশ সুপার, এক জেলার জেলাশাসক এবং দুই জেলার অতিরিক্ত জেলাশাসককে সরানো হল’।
একটি চালকলের মাঠে সভার আয়োজন করা হয়েছিল। মঞ্চে ওঠার মুহূর্তেই একটি ফোন পান মমতা। সিঁড়ির শেষ ধাপে, মঞ্চের এক কোণে কথা বলতে থাকেন। দৃশ্যতই অসন্তুষ্ট লাগছিল তাঁকে। মিনিট কয়েক পরে মঞ্চের মধ্যে এসে হাত নাড়েন জনতার উদ্দেশে। তার পরে এখানেও সুব্রত মুখেপাধ্যায়কে বক্তব্য রাখার জন্য এগিয়ে দিয়ে ফের কয়েক মিনিটের জন্য ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সুব্রতবাবুর বক্তৃতার পরে মমতা শুরুই করেন চড়া মেজাজে।
শ্রোতাদের মধ্যে সামনের সারিতে ছিলেন মহিলারা। মমতার বক্তব্য শুরুর সময় সেখানে চেঁচামেচি হচ্ছিল। গরমে মহিলাদের কষ্ট হচ্ছে অনুমান করে মমতা অসীমা পাত্র (ধনেখালির বিধায়ক) এবং রত্না দে নাগকে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। সেই ভিড় দেখিয়েই মমতা বলতে থাকেন, “চক্রান্ত চলছে রাজ্য থেকে দিল্লি পর্যন্ত। যারা চক্রান্ত করছে, তারা যদি দেখত যে ভিড়ের চাপে মহিলারা বসতে পারছেন না, পুরুষদের পদপিষ্ট হওয়ার আশঙ্কা, তা হলে বুঝতে পারত, জনতা কী বলছে।”
এর পরেই নির্বাচন কমিশনকে বেনজির আক্রমণ।