বড়রা আগেই মুখ ফিরিয়েছে। এ বার ছোটদের জন্য আয়োজনেও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না!
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসন বিজ্ঞাপন দিয়ে বহু বার আবেদন করা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের ২৩টি সরকারি শিল্পপার্কে টাকা ঢালতে কার্যত আগ্রহ দেখায়নি কোনও বড় ও মাঝারি সংস্থা। ফলে এখনও পার্কের তিন হাজার একর জমি ফাঁকা পড়ে রয়েছে। বাধ্য হয়ে নবান্ন এখন ছোট ও মাঝারি শিল্পের জন্য বেসরকারি উদ্যোগে শিল্পপার্ক তৈরির উদ্যোগ শুরু করেছে। কিন্তু দু’-দু’বার বিজ্ঞাপন দিয়ে তাতেও সাড়া মিলছে না।
পরিণামে পশ্চিমবঙ্গের শিল্প-ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্নটা ফের সামনে চলে এসেছে। আগামী মাসে বিশ্ববঙ্গ শিল্প সম্মেলনের আগে এই সব দৃষ্টান্ত সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের কী বার্তা দেবে, তা ভেবে নবান্নের আধিকারিকেরা রীতিমতো উদ্বিগ্ন।
বিরোধী দলে থাকার সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে জমি নীতি ঘোষণা করেছিলেন, ক্ষমতায় আসার পরেও তা আঁকড়ে ধরে থাকায় এ রাজ্য থেকে বড় শিল্প মুখ ফিরিয়েছে। তৃণমূল জমানায় তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং শাসকদলের মদতে পুষ্ট সিন্ডিকেট-রাজের রমরমা। “আইন-শৃঙ্খলায় অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি বা শিল্প-পরিকাঠামোয় ঘাটতি তো আছেই, সার্বিক ভাবে সরকারের মনোভাব দেখেই বিশেষ কেউ এখানে লগ্নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। উল্টে অনেক সংস্থা রাজ্য ছেড়ে চলে গিয়েছে, কেউ কেউ তালা ঝোলানোর অপেক্ষায়।” মন্তব্য করেছেন নবান্নের এক অফিসার।
এই অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, ছোট-মাঝারি শিল্পই তাঁদের ‘পাখির চোখ।’ কিন্তু প্রশাসনিক সূত্রে বলা হচ্ছে, বড় ও মাঝারি শিল্পের জন্য যে সব সরকারি শিল্পপার্ক চিহ্নিত হয়ে রয়েছে, সেখানে ছোট কারখানা করাটা অসুবিধাজনক। উপরন্তু সেগুলির সিংহভাগ প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যে কারণে সেখানে কাঁচামাল নিয়ে যাওয়া ও উৎপাদিত সামগ্রী বাজারে আনার ব্যয় বহন করাটা অনেক ছোট শিল্পোদ্যোগীর সাধ্যের বাইরে। পাশাপাশি শিল্পপার্কে যাতায়াতের রাস্তাঘাট ও অন্যান্য পরিকাঠামো বাড়ন্ত। পার্কের ভিতরের পরিকাঠামোও তথৈবচ। ফলে অধিকাংশ সরকারি শিল্পতালুক ধুঁকছে।
এমতাবস্থায় ছোট শিল্পের জন্য আলাদা পার্ক তৈরির ভাবনা। অথচ সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণ করতে সরকার রাজি নয়। দু’কূল বাঁচাতে গত অগস্টে রাজ্য মন্ত্রিসভার শিল্প বিষয়ক স্থায়ী কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ছোট শিল্পের জন্য পার্ক গড়বে বেসরকারি উদ্যোগীরা। ২৪ সেপ্টেম্বর ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প দফতর এই সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি জারি করে। তাতে বলা হয়, কোনও ব্যক্তি বা বাণিজ্যিক সংস্থা নিজেদের উদ্যোগে কমপক্ষে ২০ একর জমি কিনে তাকে শিল্পপার্কে রূপান্তরের জন্য সরকারকে আবেদন জানাতে পারবে। জমির উন্নয়ন থেকে শুরু করে সামনের রাস্তা, আলো ও নিকাশি ব্যবস্থার মতো প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তাদেরই গড়ে তুলতে হবে। কাজ হয়ে গেলে তারা জমিটি আগ্রহী সংস্থা বা ব্যক্তিকে পছন্দসই দামে বেচতে পারবে। অন্য দিকে সরকার নিজের খরচে পার্কে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে দেবে। শুল্ক-ছাড়ও মিলবে।
তবে বেসরকারি লগ্নিকারী গাঁটের কড়ি খরচা করে পার্ক বানালেও পার্কের জমি কী ভাবে ব্যবহার হবে, সরকারই তা আগাম স্থির করে দিয়েছে। যেমন, মোট জমির ৬০% কারখানার জন্য চিহ্নিত করে তাতে ন্যূনতম কুড়িটি শিল্প-কারখানা তৈরির সংস্থান রাখতে হবে। এর বাইরের জমিতে থাকবে হস্টেল, আবাসন, অফিস, ক্যান্টিনের মতো সাধারণ পরিষেবা ও সবুজায়নের বন্দোবস্ত। দফতর এ-ও বলে দিয়েছে, শিল্পপার্ক তৈরির দোহাই দিয়ে অনন্তকাল জমি ফেলে রাখা যাবে না। সরকারি অনুমতি মেলার তিন মাসের মধ্যে কাজ শুরু করতে হবে, যা শেষ হওয়া চাই দু’বছরের মধ্যে।
এই বিজ্ঞপ্তিকে সামনে রেখে ক্ষুদ্রশিল্প দফতর গত ১৫ নভেম্বর সংবাদপত্রে প্রথম বিজ্ঞাপন দেয়। প্রকল্পে অনুদান দেওয়ার কথাও জানানো হয় বিজ্ঞাপনে। যেমন, ২০ একর জমির জন্য দু’কোটি, তার বেশি হলে চার কোটি, এবং ৬০-৭৯ একর জমির ক্ষেত্রে ছ’কোটি টাকা অনুদান মিলবে। ১০০ একর বা তার বেশি জমিতে পার্ক করলে সরকার অনুদান দেবে সর্বোচ্চ ১০ কোটি টাকা। এত কিছু করেও কারও কাছ থেকে সাড়া না-পেয়ে দফতর ৮ ডিসেম্বর ফেরবিজ্ঞাপন দিয়েছে। এবং এখনও এক জন লগ্নিকারীও আগ্রহ দেখায়নি বলে সরকারি সূত্রের খবর।
নবান্নের কর্তারা এমন পরিণতি আশা করেননি। তাই বিজ্ঞাপন দেওয়ার আগেই দফতর টেন্ডার ডেকে প্রকল্পের পরামর্শদাতাও (ট্রানজাকশন অ্যাডভাইসর) নিয়োগ করে ফেলেছে!
যদিও শিল্পমহল বলছে, এমনটাই তো প্রত্যাশিত ছিল। এমনিতেই রাজ্যের ভাবমূর্তি শিল্পের অনুকূল নয়। তার উপর ভারী শিল্প না-থাকলে ছোট ও মাঝারি শিল্পও আসে না। বড় শিল্পের সহযোগী হিসেবেই এই ধরনের শিল্পে লগ্নির ঢল নামে। যেমনটা আশা করা হয়েছিল সিঙ্গুরের ক্ষেত্রে। সেখানে টাটাদের ন্যানো গাড়ির কারখানা হলে সহযোগী অনেক ছোট ছোট কারখানা তৈরি হতো বলে জানাচ্ছেন শিল্প বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, এ রাজ্যে এখন বড় শিল্প নেই, ফলে ছোট ও মাঝারি শিল্প স্থাপনে আগ্রহী লোকেরও যে অভাব হবে, সেটাই স্বাভাবিক। তাই তাদের জন্য শিল্পপার্ক গড়তেও আগ্রহ দেখাচ্ছেন না কেউ।
রাজ্যের ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প দফতরের প্রতিমন্ত্রী স্বপন দেবনাথ অবশ্য পুরো বিষয়টি সম্পর্কে অন্ধকারে। যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমি কিছু জানি না। খোঁজ নিয়ে বলব।” পরে আর মন্ত্রী ফোন ধরেননি। এসএমএসেরও জবাব দেননি।
সরকার পাশে না-দাঁড়ালে কোনও বেসরকারি সংস্থার পক্ষে কি এক লপ্তে অন্তত কুড়ি একর জমিও কেনা সম্ভব, সেই প্রশ্নও উঠেছে। বস্তুত একাধিক শিল্পোদ্যোগী জানিয়েছেন, এ রাজ্যে নিজের কেনা জমিতে কোনও কাজ করতে গেলেই সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়তে হচ্ছে। “এতটা জমি কিনতে গেলে তো দালালদের দাপটে পথে বসতে হবে!” আশঙ্কা অনেকের। সরকারের এক মুখপাত্রের অবশ্য দাবি: বহু লগ্নিকারীর হেফাজতে বিভিন্ন জেলা-শহরে পর্যাপ্ত জমি রয়েছে। মূলত এঁরাই শিল্পপার্ক করতে এগিয়ে আসবেন বলে তাঁদের আশা।
যদিও সেই আশা দুরাশা বলেই মত শিল্পমহলের।