রাজ্যে ভোটযুদ্ধ পাঁচ দফায়

মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ, তাই রাজি খোকাবাবু

এম জি রামচন্দ্রন: ৫০। এন টি রামরাও: ৫৯। অমিতাভ বচ্চন: ৪৬। ভারতীয় নায়কদের রাজনীতিতে আসার বয়সের রেকর্ডটা আজ ভেঙে দিলেন দেব। তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে মাত্র ৩২ বছর বয়সে ভোট-যুদ্ধে নামার ‘চ্যালেঞ্জ’ নিলেন তিনি। “সিদ্ধান্তটা নেওয়া চাঁদের পাহাড়ে ওঠার চেয়েও কঠিন ছিল,” হাসছেন নায়ক। কেন? “সিনেমাটা আমার চেনা এলাকা। কিন্তু রাজনীতির আমি কিচ্ছু জানি না।”

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী ও ইন্দ্রনীল রায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৪ ০৯:৩৭
Share:

সে দিন ব্রিগেডে।

এম জি রামচন্দ্রন: ৫০। এন টি রামরাও: ৫৯। অমিতাভ বচ্চন: ৪৬।

Advertisement

ভারতীয় নায়কদের রাজনীতিতে আসার বয়সের রেকর্ডটা আজ ভেঙে দিলেন দেব। তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে মাত্র ৩২ বছর বয়সে ভোট-যুদ্ধে নামার ‘চ্যালেঞ্জ’ নিলেন তিনি।

“সিদ্ধান্তটা নেওয়া চাঁদের পাহাড়ে ওঠার চেয়েও কঠিন ছিল,” হাসছেন নায়ক। কেন? “সিনেমাটা আমার চেনা এলাকা। কিন্তু রাজনীতির আমি কিচ্ছু জানি না।”

Advertisement

তা হলে রাজনীতিতে আসতে রাজি হলেন কেন? এর আগে ব্রিগেডের মঞ্চে দেবকে দেখা গিয়েছে একাধিক বার। মমতারই আগ্রহে বিবেকানন্দের সার্ধশতবর্ষে গেরুয়া পোশাকে সেজেছিলেন। সেখান থেকে ভোটযাত্রার ‘লে ছক্কা’ হাঁকালেন কী ভাবে? ইন্ডাস্ট্রি সূত্রের খবর, গোটা ব্যাপারটাই ঘটেছে খুব দ্রুত। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে নায়ককে ভোটে দাঁড়ানোর প্রস্তাব দেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজি করানোর দায়িত্ব বর্তায় ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের শ্রীকান্ত মোহতার উপর। সারা রাত বোঝানোর পরেও দেব যথেষ্ট নার্ভাস ছিলেন। চূড়ান্ত মত দিলেন বুধবার দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে। বললেন, “মমতাদির কাছে আমি কৃতজ্ঞ। ঘাটাল আমার মাতৃভূমি।”

১৯৬২-তে এম জি রামচন্দ্রন যখন তামিল বিধান পরিষদ নির্বাচনে দাঁড়ান, কংগ্রেস-বিরোধী দ্রাবিড় রাজনীতিতে তিনি তখনই পরিচিত মুখ। আটের দশকে অন্ধ্রপ্রদেশে ‘তেলুগু দেশম’-এর প্রতিষ্ঠাতা এন টি রামরাও-ও তাই। অতঃপর আজকের বিজয়কান্ত-চিরঞ্জীবী অবধি দক্ষিণী রাজনীতির সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।

কিন্তু বাংলা তো বটেই, ভারতের অন্যত্রও রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারা এমনটা ছিল না। কংগ্রেসি উত্তমকুমার বা বামপন্থী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কেরিয়ারের মধ্যগগনে ভোটে দাঁড়াবেন, এমনটা কেউ কোনও দিন ভাবতে পারেনি। ইন্দিরা গাঁধীর মৃত্যুর পর কংগ্রেসের টিকিটে অমিতাভ বচ্চন ইলাহাবাদে দাঁড়িয়েছিলেন ঠিকই। হেমবতী নন্দন বহুগুণার মতো দুঁদে নেতাকে পরাস্তও করেন। কিন্তু অমিতাভর রাজি হওয়ার পিছনে গাঁধী পরিবারের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ ব্যক্তিগত সম্পর্কের একটা বড় ভূমিকা ছিল। এবং অমিতাভ দাঁড়িয়েছিলেন কেরিয়ারের মধ্যাহ্ন পার করে, ‘কুলি’ ছবির দুর্ঘটনার পর। এবং পরে বলেছিলেন, সিদ্ধান্তটা ঠিক হয়নি।

আজ পর্যন্ত সুনীল দত্ত থেকে শত্রুঘ্ন সিংহ, জয়াপ্রদা থেকে গোবিন্দ কেউই নায়ক-নায়িকা হিসেবে রাজত্ব করতে করতে রাজনীতিতে যাননি। বাংলার তাপস-শতাব্দী-দেবশ্রী-চিরঞ্জিত প্রত্যেকে মমতার ডাকেই তৃণমূলে এসেছেন। কিন্তু এঁদের সকলের ফিল্মি কেরিয়ার অনেক দিন আগে পশ্চিমে ঢলেছে। যিনি এখনও কাজ করছেন পুরোদমে, সেই প্রসেনজিৎ কিন্তু ভোটে দাঁড়ানোর ঝুঁকি নেননি। ‘অমরসঙ্গী’ হিট করার পর ভোটে দাঁড়ানোর প্রস্তাব পেলে কী করতেন? বুম্বার উত্তর, “অমরসঙ্গী কী বলছেন? এখনও বললে রাজি হব না। ওটা আমার কাজ নয় ভাই!”

তা হলে দেব কি রাজি হয়ে ঠিক করলেন? দ্বিধাবিভক্ত টালিগঞ্জ। নায়ক, পরিচালক ও প্রযোজকদের একাংশ বলছেন, খান দশেক বাণিজ্য-সফল ছবির উড়ান নিয়ে ভোটে দাঁড়ানো আর হারাকিরি করা একই ব্যাপার। সিনেমা-টিভি মিলিয়ে দেবের উপর প্রায় ২৫ কোটির লগ্নি ঝুলছে। এপ্রিলে অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীর ‘বুনো হাঁস’ মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। প্রযোজকদের কপালে এখন গভীর ভাঁজ। মুক্তি পিছোনো প্রায় নিশ্চিত। নিসপাল সিংহ রানে দেব এবং মিঠুনকে নিয়ে পরের ছবি ভেবেছিলেন। এক নায়ক রাজ্যসভায়, অন্য জন ভোটের ময়দানে গিয়ে তা-ও শিকেয় তুললেন। ভেঙ্কটেশ দেবকে নিয়ে পরের ছবির জন্য চন্দ্রকোনায় এক কোটি টাকার সেট তৈরি করেছিল। সেই শু্যটিংও আপাতত করা যাবে না। এত সব জেনেও দেবকে রাজি করালেন কেন? শ্রীকান্তের আশা, “ও সংসদে গেলে বাংলা ছবির মুখ উজ্জ্বল হবে।”

‘পাগলু’র ঘনিষ্ঠরা ভরসা রাখছেন, নায়কের পরিণত বুদ্ধির উপরে। তাঁদের বক্তব্য, “ও ঠিকই দু’টো দিক একসঙ্গে সামলে দেবে।” কারণ, এখন নায়কদের বছরে দু’তিনটি ছবি করলেই হয়। এক-একটি ছবিতে ইনডোর-আউটডোর মিলে গড়পড়তা ৪০ দিনের কাজ। তার পর হপ্তাদুয়েক ডাবিংয়ের জন্য ধরলেও তিনটি ছবির জন্য বছরে ১৫০ দিন। নিজের লোকসভা এলাকাকে সময় দেওয়ার জন্য ২০০ দিন হাতে থাকল! ‘খোকাবাবু’র প্রযোজক অশোক ধানুকা উদাহরণ দিচ্ছেন, “গোবিন্দ নিজের এলাকায় সময় দিতে পারেননি, সুনীল দত্ত দিয়েছেন। দেব বুদ্ধিমান, পরিশ্রমী। ও পেরে যাবে!”

কিন্তু শুধু এলাকায় সময় দিলেই তো হল না! সংসদে নিয়মিত হাজিরা দেওয়া, দলের হয়ে গলা ফাটানো পারবেন দেব? নাকি ভোট ফুরোলেই সেলিব্রিটি-সুলভ আচরণে রাজনীতির ময়দান থেকে উধাও হয়ে যাবেন? নায়কের ঘনিষ্ঠ মহল বলছেন, দেব যখন ভোটে দাঁড়াতে রাজি হয়েছেন, তখন সব দিক ভেবেই রাজি হয়েছেন। রাজনীতিকে গুরুত্ব দেবেন বলেই মনস্থির করেছেন। জিতলে সংসদের অধিবেশনের সময়ের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েই শু্যটিং শিডিউল তৈরি করবেন।

কারও কারও মতে, কমবয়সে রাজনীতিতে আসাটা দেবের পক্ষে ‘অ্যাডভান্টেজ’ই হবে। নায়ক অনেকটা সময় পাবেন নিজেকে রাজনীতিক হিসেবে তৈরি করতে।

কিন্তু ভক্তমহল ভাগ হয়ে যাবে না? সিনেমার দর্শকের মধ্যে সিপিএম-তৃণমূল এসে পড়বে না? প্রযোজকরা আশা করছেন, দেব তাঁর নিজস্ব ক্যারিশমায় সেই বৈতরণীও পার করবেন! সমাজবিদ আশিস নন্দী বলছেন, তাতে রাজনীতিরও লাভ! সেলিব্রিটিকে দাঁড় করাতে পারলে জাতধর্মবর্ণদল নির্বিশেষে মানুষের মন টানতে সুবিধা হয়। মানুষও মনে করেন, তারকার নিজস্ব ব্র্যান্ড সব কিছুর ঊধের্ব। অনেকে এ-ও বিশ্বাস করতে ভালবাসেন যে, তারকার ছটা আমলাতন্ত্রের খাঁচা ভাঙার ক্ষমতা রাখে!

২৪ ঘণ্টার টিভি চ্যানেলের যুগে রাজনীতিকদেরই আজকাল সেলিব্রিটির মতো বোলচাল রপ্ত করতে হয়। একই ভাবে রাজনীতির ভাষা বদলে যাচ্ছে বলেই কি তরুণ নায়ককেও ভোটে নামতে হয়!

দেব অধিকারীর ভোটযুদ্ধ শুধু দক্ষিণ ভারতীয় রাজনীতির রিমেক নয়। আর একটু বেশি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন