হর্ষবর্ধন বর্মা ও মিল্টন বর্মা
মাসে চার হাজার টাকা পারিশ্রমিক। কাজ বলতে জঙ্গিদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নজরদারি।
নয়ন তালুকদার আর হৃদয় সরকারের ডিউটির সময়--সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টো। আবার দুপুর ২টো থেকে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত ডিউটিতে থাকেন বিপ্লব তালুকদার ও অমিত দাস। ঘোলানি নদীর পাড়ে, সাহেবপাড়ায় বসে নদীর দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখাই ওঁদের কাজ। রোজ সকাল ৯টা থেকে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত খেয়া পারাপার হয় নদীতে। ও পারে বালাপাড়ার জঙ্গল। আর তার পরেই অসমের কাশিয়াবাড়ি।
কামাখ্যাগুড়ি কলেজের স্নাতক তৃতীয় বর্ষের ছাত্র নয়নের কথায়, “আমাদের বলা হয়েছে, অসমের নম্বর প্লেটের কোনও মোটর সাইকেল নদী পেরোলেই সেই খবর ফোন করে থানায় দিতে হবে।” দক্ষিণ চ্যাংমারি গ্রামের চার যুবককে সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার হিসেবে নিয়োগ করেছে কুমারগ্রাম থানা।
জলপাইগুড়ির বজরাপাড়ায় বিস্ফোরণের পর জানুয়ারি থেকে লোকসভা ভোট না মেটা পর্যন্ত নজরদারির কাজে অস্থায়ী ভাবে তাঁদের বহাল করা হয়েছে। বেশ কয়েক বার গোয়েন্দারা খবর পেয়েছেন, আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়ির জনবহুল এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটানোর উদ্দেশ্য নিয়ে কেএলও জঙ্গিরা অসম থেকে বালাপাড়ার জঙ্গল আর ঘোলানি নদী পেরিয়ে কুমারগ্রাম দিয়ে ঢোকার মতলব করছে।
অথচ রোজ এখানে পুলিশের পক্ষে নজরদারি চালানো সম্ভব না। এতটাই প্রত্যন্ত এই এলাকা। বারোবিশা-কুমারগ্রাম সড়কের উপর পূর্ব দিকে ঘোড়ামারা বিট অফিসের গা দিয়ে জনবসতিহীন ঘন জঙ্গলপথে প্রায় চার কিলোমিটার পেরোনোর পর ওই খেয়াঘাট। আর নদীপাড় সংলগ্ন পাশাপাশি দু’টি গ্রাম সাহেবপাড়া ও দক্ষিণ চ্যাংমারি। কিন্তু সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার নিয়োগ-ও পুলিশকে আশ্বস্ত করতে পারছে না।
নয়নের বক্তব্য, “এখন ওরা মোটর বাইক নিয়ে নৌকায় উঠছে না। এ দিকেই ওদের জন্য বাইক রাখা থাকছে। এখানে ওদের লোক আছে।”
ওই সমস্ত লোক বা লিঙ্কম্যানদের মাধ্যমেই কুমারগ্রাম ও বারোবিশার কয়েক জন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কেএলও নিয়মিত তোলা আদায় করছে বলে জেনেছে পুলিশ। তাঁদের দাবি, কুমারগ্রামে কোটি টাকার সুদের কারবার করা এক ব্যক্তি মাসে অন্তত ২৫ হাজার টাকা তোলা দিচ্ছেন জঙ্গিদের। আবার কুমারগ্রামের এক ওষুধ ব্যবসায়ী, বারোবিশার এক ঠিকাদার ও সিমেন্টের এক পাইকারের কাছ থেকেও মাসে ২০ হাজার টাকা আদায় করছে কেএলও। জঙ্গি সংগঠনের নেতাদের কাছে তোলাবাজির টাকা পৌঁছে যাচ্ছে লিঙ্কম্যান মারফত।
রাজ্য পুলিশের উত্তরবঙ্গের আইজি জাভেদ শামিমের কথায়, “শিলিগুড়ির আশপাশে ও জলপাইগুড়ির ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কেএলও-র তোলা আদায় আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। কিন্তু কুমারগ্রাম ও লাগোয়া এলাকায় সেটা এখনও বন্ধ করা যায়নি।” পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? আইজি-র বক্তব্য, “আমাদের কাছে কেউ কিন্তু এখনও কোনও অভিযোগ করেননি। এমনকী, গোপনেও আমাদের কিছু জানাচ্ছেন না।” সে জন্যই হাতেনাতে এখনও কাউকে ধরা যায়নি বলে পুলিশের যুক্তি।
কিন্তু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সরাসরি যারা টাকা নিচ্ছে, সেই লিঙ্কম্যানদের কেএলও এই কুমারগ্রামে পেল কী ভাবে?
উত্তর চ্যাংমারি গ্রামের বর্ধমান দাস ওরফে আগের দফায় কেএলও-র ভাইস চেয়ারম্যান হর্ষবর্ধনের কথায়, “না পাওয়ার তো কিছু নেই। রোগের কারণ না জেনেই কড়া ডোজের ওষুধ দেওয়ার মতো সমস্যার শিকড়ে না গিয়ে ফৌজি অভিযান চালিয়ে আমাদের আন্দোলন দমানো হয়েছিল।” পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই কিন্তু সদ্য বিবাহিত এবং বর্তমানে পারিবারিক বিশ বিঘে জমিতে কৃষিকাজে মনোনিবেশ করা কেএলও-র প্রাক্তন শীর্ষনেতার মতে, “অনেকের মনে ক্ষোভের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছিলই। অথচ ২০১১-র মে মাসে ক্ষমতায় আসা তৃণমূল সরকার আমাদের সঙ্গে এখনও পর্যন্ত আলোচনায় বসল না।”
আগের দফায় কেএলও-র আর এক শীর্ষনেতা, এখন টুকটাক ঠিকাদারির কাজ করা মিল্টন বর্মার কথায়, “ভুটানের সেনা অভিযান কিন্তু আমাদের কারও মন থেকেই কামতাপুর শব্দটা মুছে দিতে পারেনি।” তবে মিল্টনের বক্তব্য, “দিদি (মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) সম্প্রতি জলপাইগুড়িতে নির্বাচনী প্রচারে এসে কথা দিয়েছেন, ভোট মিটে গেলে আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন। আমরা সে কথায় ভরসা রেখে এ বারের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
হর্ষবর্ধন, মিল্টনেরা জানাচ্ছেন, পৃথক কামতাপুর রাজ্যের দাবিকে আপাতত সরিয়ে রেখে কামতাপুরি ভাষার স্বীকৃতি, কামতাপুর উন্নয়ন পর্ষদ গঠন, প্রাক্তন কেএলও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে চলা মামলাগুলির প্রত্যাহারের দাবি নিয়েও তাঁরা আলোচনায় বসতে রাজি। তাঁদের দাবি, আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্রের লাখ পাঁচেক রাজবংশী ভোটারদের অন্তত এক লাখকে তাঁরা তৃণমূলের অনুকূলে প্রভাবিত করতে পারবেন।
শাসক দলের প্রতি প্রাক্তন কেএলও নেতাদের নির্বাচনী সমর্থনের অঙ্গীকার কি নাশকতার ঝুঁকি কমাতে পারছে?
রাজ্য গোয়েন্দা শাখা (আইবি)-র এক কর্তার বক্তব্য, “ভোটের আগে কেএলও নিজের শক্তি জাহির করতে বড় কিছু ঘটাবেই। সেটা বিস্ফোরণ হতে পারে, আবার কোনও বড় ব্যবসায়ীকে অপহরণও হতে পারে।”
হষর্বর্ধন বলেন, “কেএলও-তে এখন অসমের নেতাদেরই প্রাধান্য। ওরা কী করবে, বোঝা মুশকিল।” মিল্টন মেনে নিচ্ছেন, কুমারগ্রামের বহু যুবক এলাকার বাইরে। তাঁর দাবি, “ওদের একটা অংশ কেএলও-তে নাম লিখিয়ে এখন প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।”
কিন্তু টম অধিকারী, ইকবাল সিদ্দিকি, তরুণ থাপা, মনচলাল সিংহ গ্রেফতার হওয়ার পর তো কেএলও-র চেয়ারম্যান জীবন সিংহ অনেকটাই দুর্বল!
মানছেন না মিল্টন ও হর্ষবর্ধনের কেউই, “নতুন চার জন আবার উঠে আসবে। জীবন যেমন আমাদের তৈরি করেছিল, তেমন আরও অনেককে অচিরেই তৈরি করে ফেলবে।”
সেই সঙ্গে কেএলও-র প্রাক্তন কমান্ডার-ইন-চিফ মিল্টন বর্মা মনে করিয়ে দেন, মালখান বা মাধব মণ্ডল কিন্তু এখনও ধরা পড়েনি। মিল্টনের কথায়, “মালখান যেমন ভয়ডরহীন, তেমনই নিষ্ঠুর। পরের পর খুন করতেও ওর হাত কাঁপে না। নাশকতা ঘটাতে ও একাই যথেষ্ট।”
ছবি: রাজু সাহা, নিলয় দাস
(চলবে)