প্রাচীন ভারতে যে রাস্তা ধরে রেশম আসত সুদূর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে, তাকে নাকি বলা হত ‘সিল্ক রুট’। রেশম ও মসলিন ব্যবসায়ীরা এই পথ ধরে চলে আসতেন আর্যাবর্তের এক দম মূল ভূখণ্ডে। সিকিমের এক প্রত্যন্ত গণ্ডগ্রামে বেড়াতে যাওয়ার পর এক ট্যুরিস্ট গাইড একটি রাস্তা দেখিয়ে বলেছিলেন, এটিই নাকি বিশ্ববিশ্রুত ‘সিল্ক রুট’। রাস্তার হাল দেখে মনে মনে অবশ্য ভেবেছিলাম প্রাচীনকালের রেশম কি এ রকমই ফর্দাফাঁই, ছেঁড়া আর এবড়োখেবড়ো হত? যাক সে কথা।
এত কথা যে বলছি তার কারণ, মালদা স্টেশনে কাকভোরে নেমে বালুরঘাট যাওয়ার যে আশি-পঁচাশি কিলোমিটার রাস্তা, তাতে যেতেযেতে মনে হল, এই তো! এটাই এখন পশ্চিমবঙ্গের সিল্ক রুট রেশমসরণি। এই রাস্তা কালচে সেলোফেনের মতো পিচ মুড়ে গাজোল, বুনিয়াদপুর, মহারাজপুর, কুশমাণ্ডির বাসিন্দাদের উপহার দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আমি এবং আমার থিয়েটারের চার স্যাঙাত এই রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে প্রায় মুজতবা আলির রম্যরচনার চরিত্রের মতোই থেকে থেকে ‘তওবা’ ‘তওবা’ করে উঠছিলাম। গাড়ির স্পিডোমিটারের কাঁটা আশিতে নাগাড়ে ধ্রুব হয়ে থাকছে, তা-ও পশ্চিমবঙ্গে ভাবা যায়?
কেন যাচ্ছিলাম আমরা বালুরঘাট?
অবশ্যই লোকসভা নির্বাচন। তার থেকেও বড় কথা সেখানে লড়ছেন আমাদের ‘নাট্যস্বজন’ তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী অর্পিতা ঘোষ। সেই যে পরশুরাম কবে লিখেছিলেন, ‘একে বাপ তায় বয়সে বড়’, প্রায় সে রকম ঢঙেই লিখতে ইচ্ছে করছে, ‘একে প্রার্থী তায় থিয়েটারি বন্ধু’। ফলে না গিয়ে উপায় কি? বাস্তবিকই অর্পিতা আমাদের বহু দিনের বন্ধু। মঞ্চে তো ওকে দেখেইছি, সার্ত্র থেকে অরওয়েল হয়ে টেগোর পর্যন্ত ওর স্বচ্ছন্দ গতিবিধি। তার উপরে ওকে দেখেছি সিঙ্গুরে, নন্দীগ্রামে, কেশপুরে, নেতাইয়ে কোথায় নয়? ভারতবর্ষের এক মাত্র গণনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরম নির্ভরতা অনুভব করেছি অর্পিতার উপর। তদুপরি দক্ষ সংগঠক, সুবক্তা, দায়িত্বশীল, কর্মঠ অর্পিতার আগে সত্যিই বিশেষণ অগণন।
বালুরঘাট পৌঁছে অর্পিতাকে দেখে অবশ্য সত্যিই আমরা যাকে বলে চমকে গেলাম। এতো প্রায়, ‘কোথাকার তরবারি কোথায় রেখেছো?’ আমাদের সেই জিন্স শার্ট পরিহিত, তীক্ষ্ণ কন্ঠের ঈষৎ পুরুষালি গোছের ঘাড় পর্যন্ত নামা চুলের বন্ধুটি কোথায়? এতো পুরো সেই বিজ্ঞাপনী লোগোর মতো, উল্টে দেখুন, পাল্টে গেছে! রাবীন্দ্রিক স্টাইলে শাড়িপরা, ঘটিহাতা ব্লাউজ আর স্যান্ডাল পরিহিতা রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে যাওয়া প্রার্থীকে দেখে আমরা চার জনই একেবারে যাকে বলে সেই লীলা মজুমদারের গল্পে যেমন ভূত দেখার পর চরিত্ররা ‘হাঁ’ হয়ে যেতো, প্রায় তেমনই দশা। প্রার্থী তখন ব্যস্ত সমস্ত হয়ে প্রচারে বেরোচ্ছেন। কোনও রকমে আমাদের ‘আইটেনারি’ বুঝিয়ে তড়িঘড়ি করে তিনি বেরিয়ে গেলেন।
বালুরঘাটে আসার আগে অবশ্য নানান গণমাধ্যম মারফৎ খবর পাচ্ছিলাম, ওখানে নাকি কর্মী বিক্ষোভ আছে। বহিরাগত বলে ক্ষোভবিক্ষোভ আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কোথায় কী? বালুরঘাটে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে জেলা সভাপতি বিপ্লব মিত্র থেকে মন্ত্রী শংকর চক্রবর্তী থেকে বিধায়ক বাচ্চু হাঁসদা, মাহমুদা বেগম, সত্যেন্দ্রনাথ রায় এবং ইটাহারের অমল আচার্য সবার সঙ্গে যোগাযোগ হল। প্রত্যেকেই এককাট্টা, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। প্রার্থীকে জেতাতেই হবে। তার পর অন্য কথা। গ্রামেই পার্টি অফিসে গেলাম। গঙ্গারামপুর। বিপ্লব মিত্রর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বললাম। তার পর গেলাম বালুরঘাট। মন্ত্রী শংকর চক্রবর্তীর সঙ্গে বৈঠকে। ওখানেই পেয়ে গেলাম গ্রানাইট পাথরে কোঁদা আদিবাসী শিক্ষক, তরুণ বিধায়ক বাচ্চু হাঁসদাকে। একটু পরে এলেন সত্যেন্দ্রনাথ রায়। ফোনে কথা বললাম মাহমুদা বেগমের সঙ্গে। শুরু করলাম কর্মিসভা আর জনসভা। পতিরাম, কুশমাণ্ডি, কুমারগঞ্জ, গঙ্গারামপুর, তপন কোথায় নয়। সন্ধ্যায় গেলাম হিলি। কেউ কেউ বলছিলেন, হিলিতে সমস্যা আছে। সীমান্ত অঞ্চল। শংকরদাকে বললাম, হিলিতে যেতে চাই। শংকরদা আর সহ-সভাপতি কল্যাণবাবু মিলে একটা মিটিং ডাকলেন হিলিতে।
হিলি যেতে যেতে মনে পড়ছিল বিভূতিভূষণের ‘বাক্স বদল’-এর কথা। যে গল্প থেকে পরবর্তীতে চিত্রনাট্য করেছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন, বালুরঘাট থেকে হিলি তেইশ মাইল রাস্তা। মানে সাঁইত্রিশ কিলোমিটারের মতো। এই রাস্তাও দেখলাম সিল্ক রুট। বিভূতিভূষণের সময়ে বালুরঘাট থেকে সদরডিহি হয়ে হিলি পৌঁছতে সময় লাগত (অন্তত গল্পের বিবরণে) বেশ খানিকটা। আমাদের লাগল ঘড়ি ধরে চল্লিশ মিনিট। রাস্তায় একলাখি বালুরঘাট স্টেশন পড়ল। সদ্য ট্রেন গেছে। ট্রেন চলে যাওয়ার পর সব স্টেশনকেই কেমন একাকী, বিষণ্ণ, গোবেচারা লাগে। একলাখিও তার ব্যতিক্রম নয়। হিলিতে দারুণ মিটিং হল আমাদের। ফেরার পথে শংকরদার কিছু রাজনৈতিক নালিশ ছিল।
ডিএম, এসপির কাছে একত্রে গেলাম। শংকরদা দলের পক্ষ থেকে নালিশ জানালেন। ডিএম খই খেতে খেতে শুনছিলেন। নির্বিকার মুখে। সুদেহী তরুণ এসপি ঘন ঘন মাথা নাড়ছিলেন। দু’জনের থেকেই আশ্বাস এবং চা, দুই-ই পেয়ে এবং খেয়ে আমরা যখন বেরোলাম, মফস্বল শহরের পক্ষে অন্তত রাত ভালই হয়েছে। তবে ডিএম অফিসেই খবর পেলাম, সামনেই মুখ্যমন্ত্রী আসছেন। বুঝলাম যে হাওয়া এখন বালুরঘাটে অর্পিতার পক্ষে বইছে, তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এলে ঝড়ে পরিণত হবে। তার পরের দিন নাকি আবার আমাদের রাজ্যসভার সাংসদ, সুপারস্টার মিঠুন চক্রবর্তী। বুঝলাম অর্পিতাকে রাখে মমতা, মারে কে? তবু সাবধানের মার নেই।
শংকরদা চলে যাওয়ার পর ফেরার পথে কালিপদর সঙ্গে আলাপ শুরু করলাম। কালিপদ জনৈক রাজুর ড্রাইভার। আপাতত আমাদের দায়িত্বে। মধ্যবয়স্ক কালিপদ সর্বদাই গম্ভীর এবং সতর্ক। আমার প্রশ্ন শুনে কালিপদ অবশ্য সময় নিলেন না। বললেন, গোড়ায় সমস্যা ছিল। এখন সব মিটে গিয়েছে। বললেন, এ সব গরমের কথা, পরে নেতিয়ে গেছে। এখন কালিপদ যদি নেতিয়ের জায়গায় মিইয়ে গেছে বসিয়ে বলতেন, তা হলে তা অনেকটা রবিঠাকুরের গানের কলির মতোই শোনাতো, ‘গ্রীষ্মের তপন বারিধারা মমতায় গেছে মিইয়ে’! কিন্তু এ সব কথা গম্ভীর কালিপদর খুব ভাল লাগবে বলে মনে হল না। রাতও বাড়ছিল।
পরের দিন ইটাহার। শালপ্রাংশু মহাভুজ শ্রী অমল আচার্য আমাদের অভ্যর্থনা করলেন। এখানেও প্রার্থী নেই। সভা চারটি। অমলবাবু বরাবরই মিষ্টভাষী। তার সঙ্গে অনুরূপ প্রকাণ্ড পুরনো পরিচিত জনাব নাজমুল হোসেনও। নাজমুল সাহেব আমাকে একটি আস্ত সিগারেট খাইয়ে আশ্বাস দিলেন, ইটাহারে শেষ সভায় প্রার্থী আসবেন। প্রার্থী এই মুহূর্তে হরিরামপুরে ঢুকেছেন। অগত্যা চারটে সভাই করা গেল। অমল আচার্য গ্রামে বক্তৃতা করে বেরিয়ে যাচ্ছেন। নাজমুল সাহেবের তত্ত্বাবধানে অতঃপর আমি যাচ্ছি। সভার ফাঁকে ফাঁকেই আলোচনা করছিলাম। ২০০৯ লোকসভায় তৃণমূল প্রার্থী বিপ্লব মিত্র হেরেছিলেন মাত্র পাঁচ হাজার একশো ভোটে। কিন্তু ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে সাত বিধানসভার নিরিখে প্রায় পয়তাল্লিশ হাজারের লিড তৃণমূলের। সাতটি কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র একটিতে হার, কুশমাণ্ডিতে। বাকি ছয় কেন্দ্রতেই জয়। তার পর চুয়াল্লিশ বছর বাদে বালুরঘাট পুরসভা জয় এবং পঞ্চায়েতে বিপুল জয়। সব মিলিয়ে তৃণমূলের পক্ষে উত্তরবঙ্গের অন্যতম তাজা সিট এই বালুরঘাট। সভা করতে করতেই বুঝতে পারছিলাম ‘নাট্যস্বজন’ অর্পিতা জিতবেন।
ফিরতি ট্রেন ধরার পথে বিপ্লব মিত্রকে বললাম, বালুরঘাট থিয়েটার-সংস্কৃতির পক্ষে আজীবন থেকেছে। এ বারও থাকবে কিনা বলুন। বিপ্লব মিত্র স্বল্পভাষী মানুষ। কিন্তু যে ভাবে সজোরে ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললেন, বুঝলাম থিয়েটারের জয় অনিবার্য। বুঝলাম, গ্রিসে বা রোমে হোক বা বালুরঘাটে থিয়েটার অজেয়!