রোগ-দুর্ঘটনায় মৃত্যু চলছেই, ঝুঁকি কমছে না চটকল শ্রমিকদের

ধোঁয়ায় ভরে উঠেছে ঘর। ভাল করে ঠাওর করলে বোঝায় যায়, ধোঁয়া নয়, অগুন্তি মিহি পাটের উড়ন্ত তন্তু। শ্বাস নেওয়া দায়। নিভু নিভু আলোয় পাটের গুঁড়োয় অচেনা হয়ে ওঠা মুখগুলো নিশ্চুপে কাজ করে চলেছে। টিনের ছাউনির নিচে প্রবল শব্দে ঘুরছে স্পিনিং মেশিন। একটু অসতর্ক হলেই শরীর থেকে নিশ্চিত ছিনিয়ে নেবে আঙুল এমনকী হাত। সময়মতো মেশিনের গ্রাস থেকে বের করতে না পারলে প্রাণটাও। তবু যতটা ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব তার চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি নিয়েই চটশিল্পে টিঁকে আছেন ওঁঁরা।

Advertisement

রাহুল রায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৪ ০৩:৪০
Share:

চটকলের ‘অরক্ষিত’ দুই শ্রমিক পাঁচুগোপাল দাস ও লোকনাথ সাউ। ছবি: তাপস ঘোষ।

ধোঁয়ায় ভরে উঠেছে ঘর। ভাল করে ঠাওর করলে বোঝায় যায়, ধোঁয়া নয়, অগুন্তি মিহি পাটের উড়ন্ত তন্তু। শ্বাস নেওয়া দায়।

Advertisement

নিভু নিভু আলোয় পাটের গুঁড়োয় অচেনা হয়ে ওঠা মুখগুলো নিশ্চুপে কাজ করে চলেছে। টিনের ছাউনির নিচে প্রবল শব্দে ঘুরছে স্পিনিং মেশিন। একটু অসতর্ক হলেই শরীর থেকে নিশ্চিত ছিনিয়ে নেবে আঙুল এমনকী হাত। সময়মতো মেশিনের গ্রাস থেকে বের করতে না পারলে প্রাণটাও। তবু যতটা ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব তার চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি নিয়েই চটশিল্পে টিঁকে আছেন ওঁঁরা।

নিরাপত্তাহীন ঘেরাটোপে জীবন বাজি রেখে এ ভাবেই কাজ করছেন রাজ্যের চটকল শ্রমিকরা। যাঁদের অধিকাংশেরই বিমার সঙ্গে কোনও সংস্রব নেই। দাবিটা খোদ শ্রম দফতরের। তাদের সাম্প্রতিক রিপোর্টেই বলছে, রাজ্য জুড়ে সব চেয়ে ‘অরক্ষিত’ এই চটকল শ্রমিকরা। গত আঠারো বছরে (১৯৯৬ থেকে ২০১৪) রাজ্যে দুর্ঘটনাজনিত কারনে শ্রমিক-মৃত্যুর হার সব থেকে বেশি চটকল শ্রমিকদের মধ্যেই।

Advertisement

সম্প্রতি শ্রম দফতরের একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। যেখানে শিল্প ক্ষেত্রে গত আঠারো বছরে দুর্ঘটনাজনিত কারনে অন্তত এগারোশো শ্রমিক মারা গিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যাঁর সিংহভাগই চটকল শ্রমিক (৫৮.৬৭ শতাংশ)। ওই সময়কালের মধ্যে বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে কর্মরত অবস্থায় আহত হয়েছেন অন্তত ২৯ হাজার শ্রমিক।

পরিসংখ্যান শুনে তাঁর উদ্বেগ আড়াল করেননি শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক। তিনি বলেন, “খুবই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি। এমনটা হওয়ার নয়।” শিল্প-বান্ধব রাজ্য সরকার কি এর প্রতিকারে কিছু করছে? মলয় বলেন, “সবে দায়িত্ব নিয়েছি। আমি মিল-মালিক, ইউনিয়ন এবং অবশ্যই শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে যাবতীয় সমস্যার উৎস খুঁজব। তারপরে তা সমাধানের চেষ্টার কসুর করব না।”

সরকারি ওই পরিসংখ্যানের বাইরে অন্য একটি হিসেবও রয়েছে। ‘ইনস্টিটিউট অফ জুট অ্যান্ড কটন মা্যনেজমেন্ট’-এর বার্ষিক রিপোর্ট বলছে, পশ্চিমবঙ্গে গত চার বছরে চট শিল্পে দুর্ঘটনাজনিত কারণে মারা গিয়েছেন ৩১৮ জন। অঙ্গহানির ঘটনা প্রায় তিনশো। ক্রমান্বয়ে দুর্ঘটনার পরেও চট শ্রমিকদের বিমার প্রশ্ন এখনও বিশ বাঁও জলে। কেন?

চটকল শ্রমিকদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন রাজ্যের পরিবেশ দফতরের প্রাক্তন মুখ্য আইন অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়। কখনও দুঃস্থ শ্রমিকদের ব্যয়-বরাদ্দ সংক্রান্ত মামলা কখনও বা তাঁদের প্রাপ্য চিকিৎসার দাবিতে নিখরচায় মামলা লড়েন বিশ্বজিৎবাবু। তিনি বলেন, “বিমা থাকবে কি করে, চট শ্রমিকদের অধিকাংশই তো চুক্তিতে নিয়োজেতি। মিল মালিকদের অধিকাংশই তাঁদের বিমার আওতায় আনতে চান না” তিনি জানান, ওই শিল্পে গত কয়েক বছরে দুর্ঘনাক সংখ্যা এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে, সম্প্রতি ইএসআই কর্তৃপক্ষ প্রতিটি মহকুমায় একটি করে কমিটি গড়ে দিয়েছে। কমিটির সদস্যদের কাজ দুঘটনাগ্রস্ত শ্রমিকদের চিকিৎসা খাতে খরচের বহর খতিয়ে দেখা। যা সরজেমিন দেখতে গিয়ে লেগে যাচ্ছে দীর্ঘ সময়। অনেকেই তাঁদের প্রাপ্য পাচ্ছেন না।

এখন প্রশ্ন চটকলগুলিতেই ঘন ঘন দুর্ঘটনা হচ্ছে কেন? বিশ্বজিৎবাবুর ব্যাখ্যা, “সার্বিক অবক্ষয়ে ধুঁকছে চটকলগুলি। কাজের পরিবেশ নেই। নিদারুণ অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় ক্ষীণ আলোয় কোনওক্রমে কাজ হচ্ছে মিলগুলিতে। ১৯৪৮ সালের কারখানা আইন অনুুসারে প্রতিটি মিলের ভিতরেই পর্যাপ্ত আলো-বাতাস-জলেরর ব্যবস্থা থাকা দরকার। আদপে তা থাকে না। মেশিনগুলোর অবস্থাও তথৈবচ।” তাঁর দাবি, অনেক চটকলেই মেশিন বন্ধ করার সুইচ কাজ করে না। এমনও নজির রয়েছে যে, কোনও শ্রমিকের হাত মেশিনে আটকে গিয়েছে কিন্তু মেশিন বন্ধ করার সুইচ কাজই করল না। যখন বন্ধ করা গেল মেশিন ততক্ষণে হতভাগ্য আস্ত দেহটাই হয়তো থেঁতলে গিয়েছে।”

মিল চত্বরে চটের গুঁড়ো যাতে না ওড়ে সে জন্য জল ছেটানোর কথা। সে সবের ধার ধারে না মিল মালিকরা। ফলে সর্বক্ষণ উড়ছে চটের গুঁড়ো। অধিকাংশ চট শ্রমিকই তাই শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভোগেন। অনেকেই হয় যক্ষ্মা না হয় ব্রঙ্কাইটিসে আক্রান্ত।” শুধু শ্বাসকষ্টজমিত রোগ নয়, কলকাতার শিয়ালদহ ইএসআই হাসপাতালের চিকিৎসকদের উদ্যোগে গড়া ‘ইনস্টিটিউট অফ পেইন ম্যানেজমেন্ট’-এ আসা রোগীদের সিংহভাগই চটকল শ্রমিক। ওই ইনস্টিটিউটের পক্ষে সুব্রত গোস্বামী বলেন, “চটকল শ্রমিকদের মধ্যেই শিড়দাঁড়া সংক্রান্ত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা এত বেশি কেন তা খতিয়ে দেখতে আমরা একটা সমীক্ষা শুরু করেছি। নাশনাল জুট বোর্ডে সহায়তায় সেই সমীক্ষার প্রথম পর্বের কাজ শুরুও হয়েছে।” তাঁর অভিজ্ঞতা, “শিড়দাঁড়া সংক্রান্ত সমস্যায় ভোগায় চটকল শ্রমিকদের অনেকেই অকাল-অবসর নিতে বাধ্য হচ্ছেন। ওই রোগের উপশমে অন্তত ৫৫ জনের অস্ত্রোপচারও করা হয়েছিল। দুঃখের কথা, তাতেও রোগমুক্তি ঘটেনি।” চটকল শ্রমিকরা তাঁদের এই পেশাগত অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পাবেন কবে? বিশ্বজিৎবাবু বলছেন “সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন