টাকা থেকে শুরু করে গাড়ি, গাড়ির তেল, মায় চালকের মাইনেও!
সারদার কাছে এমন হরেক সুযোগ-সুবিধা নিয়েই মদন মিত্র ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে কামারহাটি কেন্দ্রে লড়েছিলেন বলে সিবিআইয়ের দাবি। আদালতে পেশ করা পরিপূরক (সাপ্লিমেন্টারি) চার্জশিটে কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর অভিযোগ: মদনবাবুর ভোট-প্রচারে সারদা আগাগোড়া গাড়ি জুগিয়ে গিয়েছে। ওই সব গাড়ির জ্বালানি থেকে চালকের বেতন সবই গিয়েছিল সারদার ঘর থেকে।
গত বুধবার আলিপুরে অতিরিক্ত মুখ্য বিচারক হারাধন মুখোপাধ্যায়ের এজলাসে সারদা রিয়েলটি মামলায় সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট দাখিল করেছে সিবিআই। চার্জশিটের দাবি: বিধানসভা ভোটে সারদা গোষ্ঠীর যে সব গাড়ি মদনবাবুর হয়ে খেটেছিল, সেগুলির চালকেরা ইতিমধ্যে সিবিআই-কে দেওয়া জবানবন্দিতে ঘটনার কথা স্বীকার করেছেন। ওঁদের জবানবন্দি ছাড়াও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন নথি তদন্তকারীরা কোর্টে জমা দিয়েছেন। যেমন, মদনবাবুর প্রচারে সামিল কিছু গাড়ির লগ বুক। গাড়িগুলো যে আদতে ছিল সুদীপ্ত সেনের সারদা গোষ্ঠীর, তার প্রামাণ্য নথিও পেশ হয়েছে।
সারদা কেলেঙ্কারিতে নাম জড়ানো ইস্তক কামারহাটির তৃণমূল বিধায়ক, অধুনা রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদনবাবু বলে আসছেন, সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেনকে তিনি চিনতেনই না! এমনকী, আলিপুর কোর্টের এজলাসে দাঁড়িয়ে মন্ত্রী ও তাঁর কৌঁসুলিরা বাববার দাবি করেছেন, সারদার এক জন আমানতকারী বা এজেন্টও বলেননি যে, মদন মিত্রকে দেখে তাঁরা সারদায় ভরসা রেখেছিলেন।
কিন্তু বুধবারের সিবিআই-চার্জশিটের ছত্রে-ছত্রে ওঁদের যুক্তি নস্যাৎ করা হয়েছে। কী রকম?
তাতে বলা হয়েছে, মদনবাবু যখন দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুরের বিধায়ক, তখনই সারদার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার সূত্রপাত। ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে মদনবাবু উত্তর ২৪ পরগনার কামারহাটি আসনে তৃণমূলের হয়ে দাঁড়ান। তাতে অবশ্য সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে তাঁর মাখামাখিতে ভাটা পড়েনি, বরং ঘনিষ্ঠতা আরও জোরদার হয়। এতটাই যে, নিজের চেনাশোনা লোকজনকে সারদায় চাকরি দেওয়ার জন্য মদনবাবু বহু সুপারিশ পাঠিয়েছেন। সেই মতো সুদীপ্ত অনেককে চাকরিও দিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রীর ইচ্ছানুযায়ী প্যাকেটে করে তাঁকে লাখ লাখ টাকাও সুদীপ্ত ভেট পাঠিয়েছেন বলে সিবিআইয়ের অভিযোগ।
সিবিআই-সূত্রের খবর: মদনবাবুর এ হেন সারদা-সংশ্রব সম্পর্কে নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিয়েছেন তাঁরই প্রাক্তন আপ্ত-সহায়ক রেজাউল করিম ওরফে বাপি। যে কারণে পরিপূরক চার্জশিটে রেজাউলের নাম সাক্ষীর তালিকায় রাখা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর আরও দাবি, রাজ্যে পালাবদলের পরে মদন-সারদা সম্পর্ক দৃঢ় থেকে ক্রমশ দৃঢ়তর হয়ে ওঠে। প্রমাণ হিসেবে পরিপূরক চার্জশিটের সঙ্গে পেশ হয়েছে নেতাজি ইন্ডোরে আয়োজিত সারদার সভার সিডি। যে সভায় মদনবাবু বলেছিলেন, ‘সারদা বাংলার গর্ব হয়ে উঠবে, পরের বারের সভা করতে হবে সল্টলেক স্টেডিয়ামে।’ বস্তুত মদনবাবুকে সামনে রেখেই সারদায় শাসকদলের কর্মী ইউনিয়ন মাথা তুলেছিল বলে সিবিআইয়ের দাবি। সেই ‘সারদা প্রগ্রেসিভ এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন’-এর সভাপতি ছিলেন স্বয়ং মদন মিত্র!
পাশাপাশি চার্জশিটে সিবিআই বলেছে, সারদার অনুষ্ঠানে পরিবহণমন্ত্রীর উপস্থিতি যে এজেন্ট-আমানতকারীদের মনে ভরসা জুগিয়েছিল, অনেকেরই বয়ানে তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। সিবিআইয়ের বক্তব্য: সারদার বেশ কয়েক জন কর্মী ও এজেন্ট জানিয়েছেন, সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে মদন মিত্রের ঘনিষ্ঠতা দেখে তাঁদের মনে হয়েছিল, সারদা একটি বৈধ কোম্পানি, যার পাশে রয়েছে খোদ রাজ্য সরকার। ‘মদন মিত্র তৃণমূলের একাংশের কাছে তো বটেই, সার্বিক ভাবে জনসাধারণের কাছেও জনপ্রিয় নাম। শাসকদলের অনেকগুলো সংগঠনের মাথায় রয়েছেন তিনি। এমন এক ব্যক্তির মুখে সারদা-স্তুতি সংস্থার অবৈধ লগ্নি-কারবারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।’ পর্যবেক্ষণ সিবিআইয়ের।
মদনবাবুর আইনজীবীদের তরফে অবশ্য সিবিআই-চার্জশিটের যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। পরিবহণমন্ত্রীর কৌঁসুলি মিলন মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “এ সবই আমার মক্কেলের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ। আদালতের উপরে আমাদের আস্থা আছে। সেখানে সব মিথ্যে প্রমাণিত হবে।”
সারদা রিয়েলটি মামলায় সিবিআইয়ের মূল চার্জশিট আদালতে জমা পড়েছে গত ১৭ নভেম্বর। তাতে সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেন, তাঁর একদা ‘ছায়াসঙ্গিনী’ দেবযানী মুখোপাধ্যায়, ইস্টবেঙ্গল-কর্তা দেবব্রত (নিতু) সরকার, প্রাক্তন পুলিশ-কর্তা রজত মজুমদার, ব্যবসায়ী সন্ধির অগ্রবাল ও সজ্জন অগ্রবালের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। আর সাপ্লিমেন্টারিতে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র ছাড়াও তৃণমূলের সাসপেন্ড হওয়া সাংসদ কুণাল ঘোষ, দলের প্রাক্তন সাংসদ সৃঞ্জয় বসু ও সারদার আইনি পরামশর্দাতা নরেশ বালোড়িয়ার নাম রয়েছে। বেঙ্গল মিডিয়া, সংবাদ প্রতিদিন বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যম এবং স্ট্র্যাটেজি মিডিয়া এই তিন সংস্থারও নাম রয়েছে সারদা-রিয়েলটি মামলার পরিপূরক চার্জশিটে।