হাত তুলল টাস্ক ফোর্স, আলুর দাম আগুন

নবান্নে টাস্ক ফোর্সের বৈঠক হচ্ছে নিয়ম করে। আর খোলা বাজারে আলুর দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে! সম্প্রতি টাস্ক ফোর্সের বৈঠকে হাজির ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জ্যোতি আলুর দাম তখন ১৪ টাকা কেজিতে বেঁধে দেওয়া হয়।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৪ ০৩:২৫
Share:

খড়্গপুরের ধর্মায় দাঁড়িয়ে আলুবোঝাই ট্রাক।—নিজস্ব চিত্র।

নবান্নে টাস্ক ফোর্সের বৈঠক হচ্ছে নিয়ম করে। আর খোলা বাজারে আলুর দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে!

Advertisement

সম্প্রতি টাস্ক ফোর্সের বৈঠকে হাজির ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জ্যোতি আলুর দাম তখন ১৪ টাকা কেজিতে বেঁধে দেওয়া হয়। ওই সময়ে খুচরো বাজারে জ্যোতি আলু বিক্রি হচ্ছিল গড়ে ১৬ টাকা কেজিতে। নির্দেশিকা মানা হচ্ছে কি না, দেখতে বিভিন্ন বাজারে হানাও দেন সরকারি কর্তারা। জানানো হয়, রাজ্যের বাইরে আলু যাওয়া বন্ধ থাকবে।

কিন্তু কোথায় কী! বুধবার শহরের অধিকাংশ বাজারে জ্যোতি আলু গড়ে ২২ টাকা এবং চন্দ্রমুখী আলু ২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। রাজ্যের কৃষি বিপণন সচিব সুব্রত বিশ্বাস নিজেই বলেছেন, “গত তিন দিনে আলুর দাম কেজিতে তিন টাকা বেড়েছে।” এখন সরকারি অভিযান বন্ধ, টাস্ক ফোর্সও কার্যত হাত তুলে দিয়েছে। টাস্ক ফোর্সের সদস্য রবীন্দ্রনাথ কোলে কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন, চোরাপথে অন্য রাজ্যে আলু যাচ্ছে। এ কথা তাঁরা কৃষি বিপণন দফতরকে জানিয়েছেন। তাঁর দাবি, এ দিন রাজ্যের সীমানা সিল করা হয়েছে।

Advertisement

বস্তুত, পুজোর মরসুমে আলু বাইরে পাঠানো বন্ধ থাকবে বলে সম্প্রতি আরও একটি নির্দেশিকা জারি করেছিল সরকার। এ দিন আলুর পাইকারি ব্যবসায়ী, হিমঘর মালিক ও পুলিশকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর কৃষি বিপণন সচিব জানান, আলু বাইরে যাওয়া আটকাতে পুলিশকে নজরদারি চালাতে বলা হয়েছে। বর্ধমানে আলু-বোঝাই ২৫টি ট্রাক আটক করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক বরেন মণ্ডলের দাবি, “প্রায় ১০০ কোটি টাকার আলু রাস্তায় পড়ে রয়েছে। পুরুলিয়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরে আলুর গাড়ি আটক করা চলছে। কোন নির্দেশিকায় তা হচ্ছে, আমরা জানি না।” তাঁদের বক্তব্য, আলুর জোগানে টান নেই। কোন বাজারে কত আলু চাই, সরকার তা জানালেই সরবরাহ করা হবে। সূত্রের খবর, মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত খড়্গপুর মহকুমা পুলিশ অন্তত ১৬০টি আলুর ট্রাক আটক করেছে। খড়্গপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাদনা বরুণ চন্দ্রশেখর বলেন, “বহু লরি বোঝাই আলু অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছে বলে গাড়ি আটকের নির্দেশিকা এসেছে।”

কৃষি বিপণন সচিব এ দিন বলেন, “হিমঘর মালিকরা কোথাও নামে-বেনামে আলু রাখতে পারবেন না।” তাঁর দাবি, উত্তরপ্রদেশ এবং পঞ্জাবের আলু পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে। আর ওই দুই রাজ্যের ব্যবসায়ীরা এখান থেকে আলু নিয়ে গিয়ে মজুত করছেন। প্রশাসন সূত্রে খবর, মঙ্গলবারও আলুর দাম বৃদ্ধি নিয়ে নবান্নে স্বরাষ্ট্রসচিব, কৃষি বিপণন সচিব ও পুলিশকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। নবান্নের খবর, জেলাশাসক ও এসপি-দের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আলু যেন বাইরে না যায়। কৃষিবিপণন মন্ত্রী অরূপ রায় জানান, মুখ্যমন্ত্রী চান, রাজ্যের চাহিদা মিটিয়ে আলু ভিন্ রাজ্যে যাক।

বাজার বিশেষজ্ঞদের অধিকাংশই মনে করছেন, আলু-পেঁয়াজের কৃত্রিম অভাব তৈরি করা হচ্ছে। গুদাম থেকে চাহিদা মতো আলু যেমন বার করা হচ্ছে না, তেমনই প্রচুর আলু যাচ্ছে রাজ্যের বাইরে। অনেকের দাবি, আলু ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সরকারের নজর এড়াতে ঝাড়খণ্ড, ওড়িশার হিমঘরে তা মজুত করে রেখেছেন।

শহরের খুচরো বিক্রেতারা আঙুল তুলেছেন পাইকারি বিক্রেতাদের দিকে। তাঁদের দাবি, পাইকারি ব্যবসায়ীরা আলুর যেমন খুশি দর চাইছেন। বলে দিচ্ছেন, ‘নিতে হলে নাও, না হলে পথ দেখ।’ ফলে অনেক খুচরো ব্যবসায়ী কম আলু তুলছেন। এই ভাবেই কৃত্রিম অভাব তৈরি হচ্ছে। এ দিন কোলে মাকের্টের পাইকারি বাজারে জ্যোতি আলু ১৮০-২০০ টাকা পাল্লা (পাঁচ কেজি) দরে বিক্রি হয়েছে। চন্দ্রমুখী আলুর পাল্লার কোনও সঠিক দাম নেই বলে ব্যবসায়ীদের একাংশ জানাচ্ছেন। তাঁদের দাবি, বিভিন্ন হিমঘরে নামে-বেনামে টন-টন আলু মজুত রয়েছে। ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, সরকার এখনই মাঠে না নামলে আলুর দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। কলকাতা পুরসভার এক আধিকারিকের দাবি, সরকারের নির্দেশে গত বার বিভিন্ন বাজারে আলু সরবরাহ করেছিল পুর প্রশাসন। দামও বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ১৩ টাকায়। তাতে আলুর দাম কিছুটা কমে। এ বার সরকার কোনও নির্দেশ না দিলেও পুর বাজারের ১৪টি বাজারে ২৭টি দোকান থেকে সব্জি বিক্রি করছেন এক দল মহিলা। পুরসভার মেয়র পারিষদ (বাজার) তারক সিংহ জানান, ওই মহিলারা পেঁয়াজও বেচছেন। খোলা বাজারে পেঁয়াজের দর কেজি প্রতি ৪০ টাকা, তাঁরা বেচছেন ২৬ টাকায়।

কোলে মার্কেটের চিফ সুপারভাইজার উত্তম মুখোপাধ্যায় বলেন, “বহু আলু বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে রাজ্যের বাজারে টান পড়ছে।” অনেকের আবার যুক্তি, হিমঘরে যা আলু রয়েছে, তা সরকারি তত্ত্ববধানে বের করে দিতে পারলেও মজুতদারদের বাড়বাড়ন্ত সাময়িক ভাবে কমবে। এই পরিস্থিতি রুখতে সম্প্রতি আলু ও পেঁয়াজকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের আওতায় এনেছে সরকার। এর অর্থ, সরকার যে পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, পাইকারি এবং খুচরো বাজারের ব্যবসায়ীরা তার চেয়ে বেশি আলু ও পেঁয়াজ মজুত রাখতে পারবেন না। কিন্তু এত বজ্র আঁটুনির পরও দেখা যাচ্ছে, গেরোটা ফস্কা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন