রাজ্যের কোষাগারের দুর্দশার জন্য প্রায় প্রতিদিনই কেন্দ্রকে দোষ দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অমিত মিত্র। অভিযোগ তোলেন, পশ্চিমবঙ্গের ঋণের বোঝা কমাতে কেন্দ্র কোনও সাহায্য তো করছেই না। উল্টে রাজ্যের আয় থেকে টাকা কেটে নিচ্ছে।
কয়লাখনি নিলাম থেকে সেই কেন্দ্রীয় সরকারের মারফতই এ বার রাজ্যের কোষাগারে হাজার হাজার কোটি টাকা আসতে চলেছে। ইউপিএ জমানায় কয়লাখনি বণ্টনে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর সুপ্রিম কোর্ট ২১৪টি খনি বণ্টন খারিজ করে দিয়েছিল। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে এ বার সেই খনিগুলিই নিলাম ও বরাদ্দ করা শুরু করেছে কয়লা মন্ত্রক। তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের তিনটি খনি এখনও পর্যন্ত নিলাম হয়েছে। সেই নিলাম থেকে রাজ্য সরকারের ঘরে ১৩ হাজার কোটিরও বেশি টাকা আসতে চলেছে। বস্তুত, ৪১৬ কোটি টাকারও বেশি অর্থ এখনই পেতে চলেছে রাজ্য।
আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, কিছু খনি শুধুমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থার জন্যই নির্দিষ্ট রয়েছে। বাকি খনিগুলি সিমেন্ট ও ইস্পাত নির্মাতা সংস্থাগুলির মধ্যে নিলাম হবে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিদ্যুৎ সংস্থাগুলিকে তাদের চাহিদা, খনি থেকে দূরত্ব ইত্যাদির এবং তাদের লগ্নির ভিত্তিতে খনি বরাদ্দ করা হবে। কিন্তু বেসরকারি সংস্থাগুলিকে খনি পেতে গেলে নিলামে অংশ নিতে হবে। চাইলে অবশ্য সরকারি সংস্থাও নিলামে নামতে পারে।
নরেন্দ্র মোদী সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, নিলামের অর্থের পুরোটাই যাবে রাজ্য সরকারের কোষাগারে। কেন্দ্র তাতে কোনও ভাগ বসাবে না। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি জানিয়েছিলেন, এই সিদ্ধান্তের ফলে যে সব রাজ্য লাভবান হবে, তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ অন্যতম। কারণ পশ্চিমবঙ্গের মতো পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতেই অধিকাংশ কয়লাখনি রয়েছে। কলকাতায় শিল্প সম্মেলনেও গিয়েও সে কথা বলে এসেছিলেন জেটলি।
নিলাম শুরু হতে দেখা গিয়েছে, জেটলির কথাই সত্যি। পশ্চিমবঙ্গের যে তিনটি খনি নিলাম হয়েছে, সেগুলি হল সরিষাতলি, ট্রান্স দামোদর ও অর্ধগ্রাম। কেন্দ্রের তরফে গোটা নিলামের দায়িত্বে রয়েছেন কয়লা মন্ত্রকের যুগ্মসচিব বিবেক ভরদ্বাজ। যিনি আবার পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারেরই আইএএস অফিসার। বিবেক বলেন, “এই তিনটি খনির নিলাম থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার মোট ১৩,২১০ কোটি ৮৫ লক্ষ টাকা আয় করবে। এর ফলে কয়লার দাম ও রয়্যালটি বাবদ রাজ্য প্রত্যেক বছরে ৪১৬ কোটি ৭৪ লক্ষ টাকা করে পাবে।”
এ তো গেল মাত্র তিনটি খনির হিসেব। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে পশ্চিমবঙ্গের মোট ২১টি কয়লা খনির বণ্টন খারিজ হয়ে গিয়েছিল। কাজেই সবক’টি খনি বণ্টনের পর নিলাম ও কয়লার রয়্যালটি মিলিয়ে রাজ্যের আয় যে আরও বাড়বে, তা বোঝাই যাচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-অমিত মিত্রর জন্য সবথেকে বড় স্বস্তির কথা এই নিলাম থেকে পাওয়া অর্থ যেখানে যেমন খুশি খরচ করতে পারবেন তাঁরা। এতদিন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অভিযোগ তুলতেন, কেন্দ্রের ঠিক করে দেওয়া নির্দিষ্ট প্রকল্পেই তাদের টাকা খরচ করতে হয়। রাজ্য চাইলেও অন্য কোথাও তা কাজে লাগাতে পারে না। নিলামের অর্থে তেমন কোনও বাধানিষেধ নেই। মুখ্যমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী চাইলে এই অর্থ উন্নয়ন বা শিল্পের জন্য পরিকাঠামো তৈরিতে ব্যয় করতে পারেন। আবার খয়রাতিও করতে পারেন।
অর্থ মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, “একটি স্কুল তৈরি করতে যদি ১ কোটি টাকা খরচ হয়, তা হলে এই তিনটি খনির নিলাম থেকে পাওয়া টাকায় বছরে ৪০০ স্কুল তৈরি সম্ভব। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এই টাকায় স্কুল-সড়ক তৈরি করবেন না উৎসব-অনুষ্ঠান করবেন, সেটা তাঁর বিষয়।”
প্রথমে নিলাম হওয়া তিনটি খনির মধ্যে সরিষাতলি ও ট্রান্স দামোদর খনি দু’টি বিদ্যুৎ সংস্থার জন্য নির্দিষ্ট ছিল। সরিষাতলি পেয়েছে সিইএসসি, যারা কলকাতায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে।
এই খনিটি আগেও সিইএসসি-র হাতে ছিল। ট্রান্স দামোদর নিলামে কিনেছে রাজ্য সরকারি সংস্থা দুর্গাপুর প্রোজেক্ট, যারা দুর্গাপুর-আসানসোল এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। এতদিন এই খনিটি রাজ্য সরকারের সংস্থা ওয়েস্ট বেঙ্গল মিনারেল ট্রেডিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের হাতে ছিল। অর্ধগ্রামের খনিটি নিলামে জিতে নিয়েছে বেসরকারি সংস্থা ওসিএল আয়রন অ্যান্ড স্টিল। কলকাতার সংস্থাগুলিকে নিলামে পাল্লা দিতে হচ্ছে আদানি, জিএমআর, এসার, জিন্দলদের সংস্থাগুলির সঙ্গে।
কয়লা মন্ত্রকের যুগ্মসচিব বিবেক ভরদ্বাজের কথায়, “বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থাগুলিকে নিলামে কয়লা কিনতে হচ্ছে বলে প্রথমে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেই আশঙ্কা আদৌ নেই। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে নিলাম চলছে। ফলে গোটা প্রক্রিয়াটিতেই স্বচ্ছতা বজায় রয়েছে।”