International News

নকশি কাঁথায় স্পর্শ অস্ট্রেলিয়া থেকে

ভারতের কথা শুনতে শুনতে মেয়েকে থামিয়ে দিয়েছিলেন বৃদ্ধা। মানুষের দুঃখকষ্ট বেশি সইতে পারেন না।

Advertisement

উত্তম সাহা

শিলচর শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৪:৪৫
Share:

অশীতিপর জোন্স টিফানির সেলাই করা কাঁথা গায়ে কাছাড় ক্যানসার হাসপাতালের রোগী। —নিজস্ব চিত্র

অস্ট্রেলিয়া থেকে কাঁথা এল শিলচরের কাছাড় ক্যানসার হাসপাতালে। সেলাই করে পাঠিয়েছেন ৮০ বছরের জোন্স টাফিন। অসমের এই অঞ্চল তো বহু দূরের কথা, ভারতে আসেননি কখনও। সরাসরি কোনও অভিজ্ঞতা বা নিজস্ব আবেগের জায়গা নেই। ইদানীং মেয়ে পেনেলোপি বছরে এক বার এই কাছাড় ক্যানসার হাসপাতালে আসেন। এখানকার পেন অ্যান্ড পেলিয়াটিভ ডিপার্টমেন্টে নার্সদের প্রশিক্ষণ দেন। সম্পর্ক বলতে ওইটুকুই। মেয়ের চোখেই তাঁর ভারত দেখা। এখানকার ক্যানসার রোগীদের গল্প শোনা। পেনেলোপির কাছ থেকেই তিনি জেনেছেন, ভারতের প্রচুর ধনসম্পদ রয়েছে। আবার এমন অনেক মানুষ রয়েছেন, যাঁদের ক্যানসার ধরা পড়লে দ্বিতীয় বার ডাক্তারের কাছে যেতে চান না। কোথা থেকে ওষুধের টাকা আসবে! কে দেবে তাঁদের গাড়িভাড়া! যন্ত্রণা সহ্য করতে না-পেরে শেষ সময়ে যখন হাসপাতালে আসেন, তাদের অনেকের কাঁথা-কম্বল পর্যন্ত থাকে না। কাছাড় ক্যানসার হাসপাতালের উদাহরণ টেনে পেনেলোপি মাকে শোনান, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই সমাজের কাছ থেকে তাঁদের জন্য কাঁথা-কম্বল চেয়ে আনেন। সোসাইটি পরিচালিত হাসপাতালটি প্রায় বিনা খরচে দরিদ্র ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা করে।

Advertisement

ভারতের কথা শুনতে শুনতে মেয়েকে থামিয়ে দিয়েছিলেন বৃদ্ধা। মানুষের দুঃখকষ্ট বেশি সইতে পারেন না। গৃহবধূ হলেও আজীবন চেষ্টা করেছেন মানুষের পাশে দাঁড়াতে। তাই ৯ হাজার কিলোমিটার দূরে থেকেও সুঁই-সুতো নিয়ে বসে পড়েন। গত বছর মেয়ে ভারতে আসার আগে তাঁর হাতে তুলে দেন ৯টি কাঁথা। এ বার দিলেন ২০টি।

বুদ্ধদেব কাঁথা গায়ে দিতেন। কাঁথা ব্যবহার করতেন চৈতন্যদেবও। স্টেলা ক্রামরিশের লেখায় এর উল্লেখ রয়েছে। কবি ভারতচন্দ্র রায় অন্নদামঙ্গল কাব্যে শিবকে ঝুলি-কাঁথা-বাঘছাল পরিহিত বলে উল্লেখ করেছেন। উইকিপিডিয়ায় রয়েছে, কাঁথা বা খেতা বা কেন্থা বা শুজনি প্রধানত গ্রামবাংলার (বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ) হাতে সেলাইয়ের কাজ করা আচ্ছাদন বস্ত্র।

Advertisement

আরও পড়ুন: কাশ্মীর-মধ্যস্থতা করুন, ভারত সফরের আগে ট্রাম্পকে আর্জি পাকিস্তানের

তবে কাঁথা যে শুধুই বুদ্ধ-চৈতন্য বা গ্রামবাংলার মানুষের আচ্ছাদন বস্ত্র নয়, জোন্স-পেনেলোপি টাফিন এর বড় উদাহরণ। আজকাল বরং বাঙালিদের মধ্যে কাঁথার প্রচলন উঠে গিয়েছে। হালকা শীতে এখন আর কেউ কাঁথা টেনে নেন না। পিসি-মাসি, দিদিমা-ঠাকুমারা বসে নবজাতকের জন্য পুরনো কাপড়ে কাঁথা সেলাই করছেন, সেই দৃশ্যও বিরল হচ্ছে শহরে। কাঁথা এখন প্রদর্শনীর বস্তু। হস্তশিল্পের মেলায় এক-দু’টো সাজিয়ে রাখা হয়।

পেনেলোপি জানালেন, তাদের ওখানে কাঁথার বহুল ব্যবহার রয়েছে। এই সময়ে তাঁরা ঘুমোনোর সময় কাঁথাই গায়ে দেন। অতিথি গেলে সবচেয়ে সুন্দর কাঁথাটিই খুঁজে দেন।

‘বাংলার নকশিকাঁথা’ বইয়ে শীলা বসাক লিখেছেন, ‘‘কাঁথার সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্নেহ-প্রীতি, প্রেম-ভালবাসা-আবেগ।’’ তার প্রতিধ্বনি শোনা গেল কাছাড় ক্যানসার হাসপাতালের সঙ্গে জড়িত সমাজসেবী সীতালক্ষী কান্নানের মুখে, ‘‘শুধু দু’দফায় পাঠানো ২৯টি কাঁথাই নয়। সঙ্গে জড়িয়ে বহু দূরে থাকা অশীতিপর এক মায়ের স্পর্শ, শ্রম আর অকৃত্রিম ভালবাসা‌, যা দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়েছে।’’ হাসপাতালের মুখ্য প্রশাসনিক অফিসার কল্যাণ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এই দানকে কোনও অঙ্কেই মাপা যায় না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন