২১ তলা থেকে নেমে মা দেখলেন, দুই সন্তান নেই

যে আগুন বাগে আনতে মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার সকাল গড়িয়ে যায়। তখনও ১৯-২০ তলাতেই আটকে, তার বেশি এগোতে পারেননি দমকল কর্মীরা।

Advertisement

শ্রাবণী বসু

লন্ডন শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৭ ০৩:১১
Share:

কিছু দিন আগেই জঙ্গি হামলায় আতঙ্ক ছড়ায় লন্ডন ব্রিজ আর বরো মার্কেট এলাকায়। সেই বরো মার্কেট বুধবার ফের খুলল। অথচ তার আগের রাতেই পশ্চিম লন্ডনের গ্রেনফেল টাওয়ারের বিধ্বংসী আগুন ফের যেন ওলট পালট করে দিল সব। যে অগ্নিকাণ্ডের জেরে ব্রিটেনে সরকার গঠনের প্রক্রিয়াও পিছিয়ে গেল।

Advertisement

২৪ তলার ওই আবাসন থেকে যাঁরা বেঁচে ফিরেছেন, তাঁদের মুখে একটাই কথা: ‘‘দুঃস্বপ্ন পেরিয়ে এলাম।’’ লেলিহান শিখা থেকে মানুষকে উদ্ধার করে নিয়ে আসতে নেতৃত্ব দিয়েছেন যিনি, লন্ডনের দমকল বাহিনীর সেই কমিশনার ড্যানি কটন বলছেন, ‘‘২৯ বছরের কেরিয়ারে এমন অগ্নিকাণ্ড দেখিনি।’’

যে আগুন বাগে আনতে মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার সকাল গড়িয়ে যায়। তখনও ১৯-২০ তলাতেই আটকে, তার বেশি এগোতে পারেননি দমকল কর্মীরা। ভয়াবহ আগুনের সঙ্গে কী ভাবে লড়াই করেছেন বাসিন্দারা, হাদিল আলামিলি চোখের সামনে দেখেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘২৪ তলা থেকে ঝাঁপ দিলেন এক জন। তার আগে টর্চ নাড়িয়ে উদ্ধারকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন।’’ কাঁপতে কাঁপতে হাদিল বলে যান, ‘‘হেল্প হেল্প বলে চিৎকারও শুনতে পেয়েছি। কিন্তু ওঁর কাছে পৌঁছতে পারেননি কেউ। তার পরে গোটা শরীরে আগুন নিয়েই ওপর থেকে ঝাঁপ।’’ কেউ আবার গায়ে তোয়ালে, কেউ বা স্লিপিং স্যুট— সে ভাবেই নেমে এসেছেন অনেকে।

Advertisement

১১ তলার মৌনা এলোগবানি বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে শুতে যাব যাব করছিলেন। রাত দেড়টা নাগাদ বন্ধুর ফোন: তোমাদের আবাসনে তো আগুন! শুনেই বাচ্চাদের তুলে নিয়ে দরজার দিকে এগোন মৌনা। দরজা খুলতেই আগুনের হলকা। ভয়ে ফের দরজা বন্ধ করে দেন তিনি। গোটা বাড়ির একমাত্র আপৎকালীন সিঁড়ি ব্যবহার করে নামতে পেরেছেন তিনি।

২১ তলা থেকে নিজের ছয় সন্তানকে নিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করছিলেন আর এক মা। নীচ অবধি এসে দেখেন চার জন আছে। বাকি দুই সন্তানের হদিশ পাচ্ছেন না। মাত্র পনেরো মিনিটে আগুন এত আগ্রাসী হয়ে উঠবে বুঝে উঠতে পারেননি কেউ। দমকল আসার আগেই পরিস্থিতি যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আগুনের আতঙ্কে হুড়োহুড়ির মধ্যে কে কোথায় ছিটকে গিয়েছেন জানেন না। যাঁরা কোনওমতে বেঁচে গিয়েছেন, তাঁদেরও নিখোঁজ স্বজনদের কথা ভেবে উদ্বেগ কাটছে না।

আশ্রয়হীনদের খাবার দিচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ছবি: এপি

তেমনই এক জন হানান ওয়াহাবি। ন’তলায় থাকতেন ৩৯ বছরের এই মহিলা। রাত একটা নাগাদ ধোঁয়ার গন্ধে ঘুম ভেঙে যায় তাঁর। হানানের কথায়, ‘‘বসার ঘরের জানলা দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া ঢুকছে। উঠে গিয়ে বাইরে তাকাতেই বুঝলাম মারাত্মক অবস্থা। আমার জানলার পাশেই আগুনের ভয়াল আঁচ টের পেলাম।’’ জানলা বন্ধ করে হানান ছুটে বাইরে পালান বাড়ির লোককে নিয়ে।

তার পরেই মনে পড়ে ২১ তলায় ভাই রয়েছে যে! তখনও আগুন অত উপরে ওঠেনি। ভাইকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে হানান বললেন, বেরিয়ে এসো। কিন্তু ভাই তাঁকে বলেন, ‘‘মেঝেতে তোয়ালে পেতে এক ঘরে সবাইকে বসতে বলেছে দমকল। তাই বেরোচ্ছি না। কিন্তু খুব ধোঁয়া।’’ পরে এক বার ভাই, তাঁর স্ত্রী ছেলেমেয়েদের জানলা থেকে হাত নাড়তে দেখেছিলেন। তখন ঘড়িতে রাত দু’টো। তার পর থেকে আর ফোনে পাননি ভাইকে। ১৬ তলার বাসিন্দা আব্দুল হামিদ আগুনে হারিয়েছেন সব মূল্যবান কাগজ। বলছেন, ‘‘কিছু নেই। সৌদি আরবে হজে যাব কী করে? পাসপোর্টটাই হারিয়ে গেল।’’

১২০টি ফ্ল্যাটের আবাসনে এমন গল্প ঘরে ঘরে। ক’জন ঘরে ফিরবে, সেই চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে পুড়ে খাক গ্রেনফেল টাওয়ারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন