কিউবায় সাম্রাজ্যবাদীকে আমন্ত্রণ এবং বঙ্গীয় বামপন্থীগণ

৮৮ বছরের টাইমফ্রেমটা বেশ বড়, বেশির ভাগ মানুষই অতদিন বাঁচেন না। এক প্রজন্মেরও বেশি সময়। সেই অষ্টআশি বছর বাদে আবার কিউবা দেশে সরকারি সফরে যাচ্ছেন সাম্রাজ্যবাদী দেশ আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট, বারাক ওবামা। ইতিহাস বলছে, শেষ বার কিউবা সফরে গিয়েছিলেন কেলভিন কুলিজ, ১৯২৮ সালে, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এর পরে এগারোবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়েছে সেই সাম্রাজ্যবাদীদের দেশে, অনেক পরিবর্তন ঘটেছে সে দেশের অভ্যন্তরীণ এবং বিদেশ নীতিতে, বদল ঘটেছে কিউবাতেও।

Advertisement

শমীক মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৬ ১৩:৪২
Share:

৮৮ বছরের টাইমফ্রেমটা বেশ বড়, বেশির ভাগ মানুষই অতদিন বাঁচেন না। এক প্রজন্মেরও বেশি সময়। সেই অষ্টআশি বছর বাদে আবার কিউবা দেশে সরকারি সফরে যাচ্ছেন সাম্রাজ্যবাদী দেশ আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট, বারাক ওবামা। ইতিহাস বলছে, শেষ বার কিউবা সফরে গিয়েছিলেন কেলভিন কুলিজ, ১৯২৮ সালে, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এর পরে এগারোবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়েছে সেই সাম্রাজ্যবাদীদের দেশে, অনেক পরিবর্তন ঘটেছে সে দেশের অভ্যন্তরীণ এবং বিদেশ নীতিতে, বদল ঘটেছে কিউবাতেও।

Advertisement

পঞ্চাশের দশকে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেই সময়ের কিউবার শাসক ফালজেনসিও বাতিস্তাকে হটিয়ে দেশের ক্ষমতা দখল করেন ফিদেল কাস্ত্রো। ক্ষমতায় এসেই তিনি কিউবাকে কমিউনিস্ট দেশ হিসেবে ঘোষণা করেন এবং অনেক ব্যবসায়ী এবং ধনবান বিদেশিদের বিপুল ধনসম্পত্তি দখল করে সরকারি সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করেন। মোটামুটি সে দিন থেকেই কিউবা বামপন্থীদের চোখের মণি হয়ে বেঁচেবর্তে রয়েছে।

ক্যাপিটালিস্ট দেশ আমেরিকার দু’চক্ষের বিষ এই কমিউনিজম, সেখানে ঘাড়ের কাছে একটা পুঁচকে দেশ রাতারাতি কমিউনিস্ট হয়ে গেল, এটা কি সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা মেনে নিতে পারে? তাই কিউবার ওপর শুরু হল অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, ষাটের দশকের শুরু থেকে এবং তার পরে পরে বেশ কয়েকটি আক্রমণও ঘটে কিউবার ওপরে, কিন্তু প্রত্যেক বারেই ছোট্ট কমিউনিস্ট দেশটির একতার কাছে সাম্রাজ্যবাদীরা পরাজিত হন।

Advertisement

আরও পড়ুন

ওবামার কিউবা সফর, এখনই গেল গেল রব তোলার মানে নেই

কিউবার প্রতি কমিউনিস্টদের প্রেম নতুন কিছু নয়। তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া একটু বেশিই ভালবেসে ফেলে এই ছোট্ট দেশটিকে। কমিউনিস্ট সোভিয়েত রাশিয়া সেখানে পারমাণবিক ক্ষেপনাস্ত্র স্থাপন করতে চেয়েছিল, পরে যদি কখনও কাজে-টাজে লাগে। ওদিকে তখন জনএফ কেনেডি, আর এদিকে নিকিতা ক্রুশ্চেভ। উনিশশো বাষট্টি সাল। আমেরিকার আগ্রাসনে সোভিয়েত ইউনিয়নের সে প্রচেষ্টা অবশ্য অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। কিন্তু কিউবার ওপর থেকে সন্দেহের নজরদারি সরায় না আমেরিকা, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর হয়ে চেপে বসে, ঘিরে ধরে কিউবাকে, যা থেকে কিউবা মুক্ত হয় এই সে দিন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার দাক্ষিণ্যে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেই শীতল যুদ্ধের দিনগুলোতে, ফিদেল কাস্ত্রোর ওপরেও একাধিক প্রাণঘাতী হামলার ছক কষা হয়, কিন্তু তাঁকেও মেরে ফেলতে পারে নি সাম্রাজ্যবাদীরা। বরং এই উপর্যুপরি নিষেধাজ্ঞায়, আক্রমণে বামপন্থীদের কিউবা-প্রেম ও সাম্রাজ্যবাদ বিদ্বেষ আরও পরিপুষ্ট হয়েছে, পরিপূর্ণ হয়েছে। ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থা পরিস্ফূট হয়েছে, যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়, তার পরেই চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান হয়ে যান, এবং তার পরে শুরু হয় সেই বিখ্যাত “চৌত্রিশ বছর”। দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর ধরে আমরা পরিচিত হয়েছি সাম্রাজ্যবাদীদের কালো হাতের সঙ্গে। আমরা দেখেছি কী ভাবে দীর্ঘতর মিছিল করে, জনজীবন স্তব্ধ করে, সেই কালো হাত ভেঙে এবং গুঁড়িয়ে দেওয়া যায়। আমাদের বাল্য ও কৈশোরের স্মৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত কলকাতা শহরের বুকে কিউবার সমর্থনে, কিউবার সাহায্যার্থে একাধিক বাম মিছিল। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ অনাহারে মরলেও মিছিল করে চাঁদা তুলে কিউবাতে চাল পাঠাতে কখনও পিছপা হননি বঙ্গের কমিউনিস্টরা।

কিন্তু হায়, আজ সেই চৌত্রিশ বছরও নাই, সাম্রাজ্যবাদের সে রমরমাও নাই। নইলে সেই সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকাই আবার কিউবার ওপর থেকে সরিয়ে নেয় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ঘেরাটোপ, আর অষ্টআশি বছরের লিগ্যাসি ভেঙে বারাক ওবামা চলে আসেন কিউবায়? আর কিউবার জনগণ কিনা সোল্লাসে স্বাগত জানায় সেই সাম্রাজ্যবাদী প্রেসিডেন্টকে?

বঙ্গের বামপন্থীরা পড়েছেন মহা সমস্যায়। না পারছেন এখন সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে গলা ফাটাতে, না পারছেন কিউবার এহেন আচরণ হজম করতে। এত বছর ধরে সমবেদনা দেখিয়ে, চাল পাঠিয়ে, মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশে ছুঁড়ে কিউবার প্রতি সলিডারিটি দেখিয়ে, শেষে কিনা সাম্রাজ্যবাদীদের নেতাকেই তারা নিজেদের দেশে নিমন্ত্রণ করে ডেকে নিচ্ছে?

বামেরা তাই চুপ। কলকাতার বুকে, বাংলার বুকে, নিদেন কেরালার বুকেও এখন তাই আর কোনও মিছিল নেই। কমিউনিস্ট দেশে সাম্রাজ্যবাদীর আগমনে কোনও প্রতিবাদ নেই আর, ভোটের দায় বড় দায়। জোটের হিসেব কষতে তাঁরা এখন ভীষণ ব্যস্ত, সাম্রাজ্যবাদের মোকাবিলা এখন তাঁদের কর্মসূচীতে নেই, থাকবেও না হয় তো। পরিবর্তনের আর এক জোয়ারে বোধ হয় বদলে গেছে, বদলে যাচ্ছে সমস্ত সমীকরণ। হাভানার সমুদ্রতটকে ব্যাকড্রপে রেখে ওবামার হাত মিলে যাচ্ছে রাউল কাস্ত্রোর হাতে, দীর্ঘ ষাট বছর পর ক্যাপিটালিস্ট দেশ খুলে দিচ্ছে তার কমিউনিস্ট প্রতিবেশীর দেশের দিকের দরজা – হয় তো এ দেশের কমিউনিস্টরা এখন অন্যতর রফাসূত্রের খোঁজে অন্য রকম হাত মেলাতে ব্যস্ত।

অবশ্য এ দেশে বামেরাও বহুমাত্রিক। লাল রঙেরও তো রকমফের আছে, পতাকার রঙ আর রক্তের রঙ তো ঠিক মেলে না। এ দেশে সংসদীয় বামেরা যেমন আছেন, তেমনি সংসদীয় রাজনীতিতে অবিশ্বাসী বামেরাও আছেন। ভোটের দায়, জোটের দায় যাঁদের চুপ করিয়ে রাখে তাঁদের নীরবতার কারণটুকু না হয় বোঝা যায়, কিন্তু অন্য বামেদের নীরবতার কারণ কী? কিউবার বুকে সাম্রাজ্যবাদের এই সাম্প্রতিক আগ্রাসন কি তাঁদের এতটুকুও উদ্বেলিত করছে না?

কে দেবে উত্তর?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন