মার্কিন ফুডকোর্টে টক্কর বাঙালি গিন্নির হেঁশেলের

চন্দননগরের বসবাসের পাট কার্যত চুকিয়ে এক দশক আগে মার্কিন মুলুকে এসেছিলেন সামান্য চক্রবর্তী। বেসরকারি সংস্থার চাকুরে সামান্যবাবুর সঙ্গে এসেছিলেন স্ত্রী দীপ্তি এবং কন্যা সূর্যতপা।

Advertisement

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

রিভারসাইড (ক্যালিফর্নিয়া) শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৯ ০১:১৫
Share:

নিজেদের দোকানে সামান্য ও দীপ্তি চক্রবর্তী। নিজস্ব চিত্র

রূপে বা স্বাদে সে আদি কিংবা অনাদি নয়। তবু ক্যালিফর্নিয়ায় বসে কলকাত্তাইয়া মোগলাই পরোটার আকাঙ্ক্ষা মেটানো যায় বই কী! শুধু মোগলাই পরোটা কেন, অর্ডার দিলে শিঙাড়া, বেগুনি কিংবা চপ, রোলও হাতে গরম তৈরি! মুচমুচে সে সব পদ খেয়ে প্রবাসী বাঙালি তো বটেই, আহ্লাদে আটখানা বহু বিদেশি-বিদেশিনিও।

Advertisement

চন্দননগরের বসবাসের পাট কার্যত চুকিয়ে এক দশক আগে মার্কিন মুলুকে এসেছিলেন সামান্য চক্রবর্তী। বেসরকারি সংস্থার চাকুরে সামান্যবাবুর সঙ্গে এসেছিলেন স্ত্রী দীপ্তি এবং কন্যা সূর্যতপা। মা-মেয়ে মিলেই ক্যালিফর্নিয়ার রিভারসাইড শহরে খুলে ফেলেছেন খাবারের দোকান। ফুডকোর্টে মেক্সিকোর কিংবা ক্যারিবীয় হেঁশেলের সঙ্গে টক্কর দিয়ে ব্যবসা করছে বাঙালি গিন্নির রান্নাঘর।

দীপ্তি বলছিলেন, দেশে থাকতেই তাঁর রান্নার শখ। খাদ্যরসিক স্বামী রন্ধনেও পটু। এ দেশে আসার কয়েক বছর পর নিজের গ্যারাজে কেটারিং ব্যবসা খুলেছিলেন। অনুষ্ঠান, পার্টির বরাত পেলে লুচি, ছোলার ডাল, আলুর দম রেঁধে সরবরাহ করতেন। রিভারসাইডের দুর্গাপুজোর তিন দিনের খাবারের বরাত তাঁর হাতে। সপ্তাহ খানেক আগে সান দিয়েগোর এক পুজো কমিটির অনুষ্ঠানে ছানার জিলিপি পাঠাতে হয়েছিল তাঁকে।

Advertisement

তবে রেস্তরাঁর বয়স বেশি নয়। বিজ্ঞানে স্নাতক মেয়ে সূর্যতপার আগ্রহেই ফুডকোর্টে দোকান দিয়েছিলেন তিনি। হাতিয়ার করেছেন নিজের দেশের রন্ধনসম্ভারকেই। হেঁশেলের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলেছেন দীপ্তি। সাহায্যকারী হিসেবে রেখেছেন রাজশাহী থেকে আসা অলকা পালকে। ব্যবসার অন্য দিক দেখেন মেয়ে। ছুটি পেলে
খাবারের ব্যবসায় হাত লাগান সামান্যবাবুও।

তবে মার্কিন দেশে বাঙালির চিরাচরিত স্বাদকে কিছুটা হলেও বদলেছে এই বাঙালির রান্নাঘর। কর্তা-গিন্নি দুজনেই বলছিলেন, এ দেশের মানুষের খাবারে নানান সমস্যা। মুখের স্বাদও কিছুটা ভিন্ন। তাই রোলে শসা, পেঁয়াজের কুচির বদলে ক্রিম ব্যবহার করেন। বেগুনি বা চপের ঠাঁই হয়েছে ‘ভিগান’ খাদ্যের তালিকায়। রান্নায় গোটা গরম মশলার বদলে ঘরে তৈরি গরম মশলার গুঁড়ো দিতে হয়। খাবারের মুখে গোটা এলাচ বা দারচিনি পড়লে নাকি সাহেবরা মারাত্মক চটে যায়। হাড়ের ঝামেলা এড়াতে কষা মাংসে পাঁঠার বদলে ভেড়া ব্যবহার করেন। তবে আগেভাগে অর্ডার দিলে ডিম-ভাতের মতো নিখাদ বাঙালি খাবারও মেলে। ভাত পাতে নুন, কাঁচালঙ্কারও ব্যবস্থা রয়েছে। সামান্যবাবু বলছিলেন, মাঝেমধ্যে ফুলকপি দিয়ে খিচুড়ি, আলু, ডিম, মাংসের সহাবস্থানে কলকাত্তাইয়া বিরিয়ানি কিংবা কবিরাজি কাটলেটের মতো নির্ভেজাল বাঙালি পদও করা হয়।

আসলে বিদেশে ভারতীয় খানা বলতেই পঞ্জাবি কিংবা উত্তর ভারতীয় পদের কথাই লোকে বোঝেন। ওয়াশিংটন ডিসি, পিটসবার্গ কিংবা ডেনভারের মতো শহরে ইন্ডিয়ান ফুড মানে সেই তন্দুরি, পোলাও, বাটার চিকেনের পদ। নিউ ইয়র্ক বা ম্যানহাটনে অবশ্য বাঙালি খাবারের দোকান রয়েছে। কিন্তু ও-পার বাংলার সেই সব রেস্তরাঁয় খাস কলকাত্তাইয়া ভাজাভুজি ততটা চলে না।

কলকাতার অনেকেই দীপ্তি ও সূর্যতপার এই হেঁশেলের খাবার খেয়ে ‘ঠিক তেমন নয়’ বলতেই পারেন। দীপ্তির কথায়, “সাহেবদের জন্য খাবারের বহিরঙ্গে বদল আনা হয়েছে। কিন্তু রান্নার অন্তরের কোনও বদল হয়নি। মোগলাই পরোটার সঙ্গে বাঙালির চেনা আলুর তরকারি বাদ। তবে কেউ চাইলে কষা মাংস নিতেই পারেন। পেঁয়াজ বাদ গেলেও শসা কুচির স্যালাডও দেওয়া হয়। ছানা তৈরি করে রসগোল্লা বা পান্তুয়া বা ছানার জিলিপিও তৈরি হয়।”

এমনই এক বিকেলে আচমকাই বাঙালি রান্নার ঠেকে দেখা গেল এক বিদেশি যুগলকে। বাঙালি রান্না দূর অস্ত, বেঙ্গল সম্পর্কেই ধারণা নেই। তবু মোগলাই ও কষা মাংস নিয়ে বসলেন তাঁরা। তাঁদের বক্তব্য, খেতে ভাল লাগে তাই খাই।

ওই যুগলের প্লেটে খাবার তুলে দেওয়ার সময়েই রান্নাঘর থেকে ভেসে আসে চপ ভাজার গন্ধ। ক্যালিফর্নিয়ার পড়ন্ত বিকেলে সে গন্ধ যেন এক টুকরো কলকাতার ছোঁয়া!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন