পরমাণু-বিপর্যয়ের ৩০ বছর

ঝুঁকি নিয়েই ঘরে ফিরছে চের্নোবিল

হাজারো ঝড়-ঝাপ্টা পেরিয়ে দিনের শেষে ঘরে ফেরাতেই শান্তি। তা সে মেঘে-ঢাকা চেরাপুঞ্জিই হোক, বা তিরিশ বছরের পুরনো পরমাণু ক্ষত নিয়ে ধুঁকতে থাকা চের্নোবিল। শান্তি আসলে নিজের পাড়ায়, বাপ-ঠাকুরদার ডেরাতেই। সত্তর ছুঁইছুঁই বৃদ্ধা মারিয়া লজবিন অন্তত এমনটাই মনে করেন। স্বামী-সন্তান নিয়ে বছর ছয়েক আগেই তিনি ফিরে এসেছেন চের্নোবিলে।

Advertisement

সংবাদ সংস্থা

চের্নোবিল (ইউক্রেন) শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:২১
Share:

চের্নোবিল দুর্ঘটনায় মৃতদের স্মৃতিতে শ্রদ্ধা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পেট্রো পোরোশেঙ্কোর। মঙ্গলবার চের্নোবিলে। ছবি: এএফপি।

হাজারো ঝড়-ঝাপ্টা পেরিয়ে দিনের শেষে ঘরে ফেরাতেই শান্তি। তা সে মেঘে-ঢাকা চেরাপুঞ্জিই হোক, বা তিরিশ বছরের পুরনো পরমাণু ক্ষত নিয়ে ধুঁকতে থাকা চের্নোবিল। শান্তি আসলে নিজের পাড়ায়, বাপ-ঠাকুরদার ডেরাতেই। সত্তর ছুঁইছুঁই বৃদ্ধা মারিয়া লজবিন অন্তত এমনটাই মনে করেন। স্বামী-সন্তান নিয়ে বছর ছয়েক আগেই তিনি ফিরে এসেছেন চের্নোবিলে। তবে নতুন ডেরায়। দুর্ঘটনাস্থল থেকে ‘নিরাপদ দূরত্বে’। তাঁর কথায়, ‘‘ইউক্রেন থেকে বেলারুশ, বেলারুশ থেকে আবার ইউক্রেন— অনেক ছুটেছি। দুর্বিষহ একটা জীবন বয়ে বেড়িয়েছি। এখন বুঝতে পারছি নিজের ভিটেমাটির কাছেই স্বর্গ।’’

Advertisement

লজবিন এখন বাড়িতেই দিব্যি হাঁস-মুরগি পুষছেন। টুকটাক চাষও করেছেন নিজের এক চিলতে উঠোনে। তাঁর মাথার উপর এখনও বিপর্যয়ের পরমাণু-মেঘ। লজবিনের চোখে-মুখে তবু উদ্বেগের লেশমাত্র নেই। বলছেন, ‘‘এখন তো বয়স হয়েছে। গেলেই হয়! খামোখা ভয় পেতে যাব কেন!’’

তা হলে পালিয়েছিলেন কেন? ইতিহাস সাক্ষী, লজবিনরা স্বেচ্ছায় নয়, পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। সময়টা ১৯৮৬-র ২৬ এপ্রিল। আজ থেকে ঠিক তিরিশ বছর আগে। চের্নোবিল পরমাণু কেন্দ্রের ৪ নম্বর চুল্লির ভয়াবহ বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল ইউরোপের একটা বড় অংশ। রাশিয়ার পরিচিতি তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন হিসেবে। অবিভক্ত। দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল বেলারুশ ও ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে। স্থানীয় সময় তখন
রাত দেড়টা।

Advertisement

হঠাৎই বিস্ফোরণ! পর-পর দু’টি। কাঁচা ঘুম ভেঙে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তত ক্ষণে ছড়াতে
শুরু করেছে বিষাক্ত তেজস্ক্রিয় বিকিরণ। বিস্ফোরণে চুল্লির উপরের প্রায় এক হাজার টন কংক্রিটের ঢাকনা সরে যায়। ছাদ ভেঙে বিশাল এক গহ্বর তৈরি হয়। বাইরে থেকে বাতাস এসে আছড়ে পড়ে পরমাণু চুল্লির ভিতরে থাকা দাহ্য পদার্থের উপর। লাগে আগুন। পরের দশ দিনেও নেভানো যায়নি সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। লজবিনের কথায়, তাঁর পাড়ার বেশির ভাগ বাড়ির ছাদেই চিড় ধরেছিল। যখন-তখন ভেঙে পড়ার অবস্থা!

আর তেজস্ক্রিয় বিকিরণ? স্থানীয়দের দাবি, প্রথম থেকেই তা লাগামছাড়া। বিস্ফোরণের জেরে ঘটনাস্থলেই প্রাণ যায় ৪ জন কর্মীর। পরবর্তী তিন মাসে আরও ৩১ জনের। সরকারি সূত্রের খবর, ঘটনার সময়ে চের্নোবিলে প্রায় ১৫ হাজার বসতি ছিল। সব মিলিয়ে ৬ লক্ষ শিশু-সহ ৫০ লক্ষ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হন সেই ঘটনায়। সরকারি নির্দেশেই খালি করা হয় পুরো চের্নোবিল। বাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন মারিয়া লজবিনের মতো হাজার হাজার মানুষ।

বিপর্যয়ের তিরিশ বছর পূর্তিতে আজও ব্রাত্য চের্নোবিল। মূল শহরটি এখনও পরিত্যক্ত। জনশূন্য। যেখানে বিস্ফোরণ হয়েছিল, তার আশপাশের ৩০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে এখনও নির্দিষ্ট পোশাক ছাড়া জনগণের প্রবেশ নিষিদ্ধ রেখেছে দুই দেশের সরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) রিপোর্ট বলছে, চের্নোবিলে পরমাণু বিস্ফোরণের জেরে ক্যানসার হয়ে মারা গিয়েছেন অন্তত ৯ হাজার জন। বেলারুশের সরকারি তরফের সাম্প্রতিক একটি রিপোর্ট যদিও সংখ্যাটা ১ লক্ষেরও বেশি বলে জানিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, চের্নোবিলের ৩০ কিলোমিটারের বাইরের পরিস্থিতিও বাসযোগ্য নয়। আজও নানাবিধ শারীরিক অসঙ্গতি নিয়ে জন্মাচ্ছে শিশুরা।

তবু ঝুঁকির কথা মানতে নারাজ লজবিনের পরিবার। একই বক্তব্য তাঁর মতো আরও ১৬০ জনের, সম্প্রতি যাঁরা মাটির টানে ফিরে এসেছেন চের্নোবিলে। বিপজ্জনক এলাকায় ঢুকতে পুলিশ প্রথমটায় বাধা দিয়েছিল বটে, কিন্তু মানেননি লজবিনরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন