অশান্তির সূত্রপাত মাস আটেক আগে। তবে তার মাসুল যে একটি যাত্রিবাহী বিমানকে দিতে হবে, তা কেউ ভাবেননি তখন।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর স্বাধীন হয়েছিল ইউক্রেন। তার পরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয় তারা। ২০১০ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পদে জয়ী হন ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ। প্রথম কিছু দিন ভালই চলছিল। কিন্তু তিনি ক্রমেই রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছিলেন, যেটা ইউক্রেনবাসীর একটা অংশের ভাল লাগেনি।
গত নভেম্বরে ইয়ানুকোভিচ আচমকা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে নিবিড়তর বাণিজ্যের চু্ক্তি বাতিল করেন। ডিসেম্বরেই পুতিনের সঙ্গে চুক্তিপত্র সই করেন তিনি। তত দিনে রুশ-বিরোধীরা বিক্ষোভ শুরু করেছেন ইউক্রেনে। জনতা-পুলিশ সংঘর্ষ চরমে পৌঁছেছে। নড়ে বসেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নও। নতুন বছরেও প্রতিবাদ ক্রমশ সীমা ছড়াতে থাকে। রুশপন্থীরাও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শুরু করেন।
২২ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন পার্লামেন্ট ইয়ানুকোভিচকে সরানোর জন্য ভোট দেয়। ইয়ানুকোভিচ রাশিয়ায় আশ্রয় নেন। অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হন আলেকজান্দর তুরচিনভ, যিনি ফের ইউরোপীয় ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকতে থাকেন। ফলত এ বার চোখ রাঙাতে শুরু করলেন পুতিন। ইউক্রেন সীমান্ত বরাবর মোতায়েন হয়ে গেল লক্ষাধিক রুশ সেনা। রুশ-ইউক্রেন এই যুদ্ধ-পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক কূটনীতির কেন্দ্রে চলে এল।
২৭-২৮ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের অন্তর্গত স্বশাসিত রাজ্য ক্রাইমিয়ার ঢুকে রুশ বাহিনী ক্রাইমিয়ার পার্লামেন্ট দখল করে। পর দিনই রুশ পার্লামেন্টে পুতিন ইউক্রেন আক্রমণের অনুমোদন আদায় করে নেন। জবাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ঘোষণা করেন, আগ্রাসন বন্ধ না করলে রাশিয়ার উপর অর্থনৈতিক অবরোধ চাপানো হবে।
কিন্তু ইউক্রেনে রুশ-বিরোধীরা যেমন আছেন, রুশপন্থীদের সংখ্যাও কম নয়। বিক্ষোভ-প্রতিবাদে তাঁরা নেমে গিয়েছিলেন আগেই। এ বার তাঁরা রুশ মদতে বিদ্রোহী সংগঠনও গড়ে তুলতে শুরু করলেন। ১৬ মার্চ গণভোটে রাশিয়ার সঙ্গে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত নিল ক্রাইমিয়া।
পূর্ব ইউক্রেনের যে ডনেৎস্ক এলাকায় এমএইচ ১৭ ভেঙে পড়েছে, সেটি রুশপন্থীদের শক্ত ঘাঁটি। গত ৭ এপ্রিল রুশপন্থীরা সেখানে স্বঘোষিত সরকার ‘ডনেৎস্ক পিপলস রিপাবলিক’ গড়ে তোলে। রুশপন্থী এবং ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ দেশ জোড়া আকার নেয়। পূর্ব ইউক্রেনে চলতে থাকে গণভোটের প্রস্তুতি।
কিন্তু পুতিনের উপরে আন্তর্জাতিক চাপ ক্রমশ বাড়ছিল। ৭ মে পুতিন ঘোষণা করেন, গণভোটের প্রস্তুতি স্থগিত রেখে আলোচনা শুরু হোক। ইউক্রেনে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ শেষে নতুন সরকার নির্বাচন হলেও তাঁর আপত্তি নেই বলে জানান তিনি। ১৯ মে পুতিন ঘোষণা করেন, তিনি ইউক্রেন সীমান্ত থেকে সেনা সরিয়ে নেবেন। ২৫ মে পূর্বনির্ধারিত সূচি মেনেই ভোট হয় ইউক্রেনে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন পেত্রো পরশেঙ্কো। ক্ষমতায় এসেই পূর্ব ইউক্রেনকে রুশপন্থীদের দখলমুক্ত করার কাজে হাত দেন তিনি। ২০ জুন পরশেঙ্কো সপ্তাহকালীন যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে একটি ১৫ দফা শান্তি-প্রস্তাব রুশপন্থীদের সামনে রাখেন। ২৫ জুন, রুশ পার্লামেন্টও ইউক্রেন আক্রমণের পথ আনুষ্ঠানিক ভাবে পরিত্যাগ করে।
কিন্তু এই শান্তির বার্তা কতটা খাতায়কলমে আর কতটা বাস্তবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গিয়েছে। ইউক্রেনের দাবি, রাশিয়া রুশপন্থীদের পূর্ণ মদত দিয়ে চলেছে। আর রুশপন্থীরাও কিছু পুরনো ঘাঁটি ছেড়ে দিলেও লড়াই থামায়নি। এমএইচ ১৭ এই বাস্তবতারই দাম দিল।