রাষ্ট্রপুঞ্জে ভারতের প্রতিনিধি সৈয়দ আকবরউদ্দিন। ছবি টুইটার।
‘সময় শেষ হয়ে গিয়েছে’ বলে হাল ছেড়ে দেওয়া নয়। যত ক্ষণ না লক্ষ্যপূরণ হচ্ছে, চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আপনি আসলে যা ভাবছেন, তার থেকে বেশি সময়ই আপনার হাতে আছে।মহেন্দ্র সিংহ ধোনির এই আপ্তবাক্যটিই ছিল নয়াদিল্লির হাতিয়ার!
জইশ নেতা মাসুদ আজহারের নাম আন্তর্জাতিক জঙ্গি-তালিকায় তোলার কূটনৈতিক যুদ্ধ জয়ের পরে এমনটাই জানিয়েছেন রাষ্ট্রপুঞ্জে ভারতের প্রতিনিধি সৈয়দ আকবরউদ্দিন। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য ও অন্য দেশগুলির কাছে দীর্ঘদিন ধরে দরবার করে যাওয়া এবং সর্বোপরি চিনকে রাজি করানোর ফলেই এই অসাধ্য-সাধন সম্ভব হল— আজ এমন দাবিই করছে তৃপ্ত বিদেশ মন্ত্রক।
সাফল্যে যাতে দাগ না-পড়ে, তা নিয়েও সতর্ক থেকেছেন বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রবীশ কুমার। গত কাল পাকিস্তান বলেছিল, রাষ্ট্রপুঞ্জ পুলওয়ামা হামলার সঙ্গে বিষয়টিকে জোড়েনি বলেই মাসুদের নাম ওই তালিকায় তোলাকে সমর্থন করেছে তারা। আজ এই প্রসঙ্গে রবীশ বলেন, ‘‘মাসুদ আজহার এক জন আন্তর্জাতিক জঙ্গি। তালিকাভুক্ত করাটাই উদ্দেশ্য ছিল। সেটাই হয়েছে। এর সঙ্গে তার বিস্তারিত বায়ো-ডেটা দাখিলের কোনও প্রয়োজন নেই। এই সিদ্ধান্তে পুলওয়ামা অবশ্যই একটা বড় ভূমিকা নিয়েছে।’’
গত মাসে বিদেশসচিব বিজয় গোখলের চিনে যাওয়া এবং নতুন করে মাসুদ সম্পর্কে সমস্ত তথ্য দেওয়ার বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলেই দাবি ভারতের। সূত্রের অবশ্য বক্তব্য, মাসুদ আজহার চিনের কাছে একটি পড়ে-ফেলা বইয়ের মতো। অভিনব কোনও তথ্য দিয়ে ভারত বেজিংকে সমৃদ্ধ করেছে, বিষয়টা এমন নয়। কিন্তু ভারত সফল ভাবে যেটা করতে পেরেছে তা হল, নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য শক্তিধর দেশগুলিকে মাসুদ-বিরোধিতা তথা পাক-বিরোধিতার প্রশ্নে এক ছাতার তলায় আনা।
কূটনৈতিক সূত্রের মতে, গত ২১ মার্চ পুলওয়ামা হামলার কঠোর নিন্দা করে নিরাপত্তা পরিষদ যে বিবৃতিটি দিয়েছিল, সেটিই ছিল গুরুত্বপূর্ণ প্রথম ধাপ। পরিষদের তরফে এই ধরনের বিবৃতি যথেষ্ট অভিনব। সবচেয়ে বড় কথা, ওই বিবৃতিতে জইশ-ই-মহম্মদের নাম করা হয়েছিল। ফলে ভারতের পক্ষেও জইশ নেতার নাম রাষ্ট্রপুঞ্জের জঙ্গি-তালিকায় তোলার দাবিতে সুর চড়ানো সহজ হয়ে যায়। এর ঠিক ৬ দিন পরেই ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং আমেরিকা একযোগে মাসুদ-বিরোধী যে প্রস্তাবটি নিরাপত্তা পরিষদে নিয়ে আসে, তার পিছনেও ছিল ভারতের নিঃশব্দ কিন্তু জোরালো দৌত্য।
আকবরউদ্দিন জানাচ্ছেন, ‘‘কূটনীতিতে সব কিছুই সময় এবং কার্যকারণের উপরে নির্ভর করে। এ বার একটা বিরাট আন্তর্জাতিক জোট তৈরি হয়েছিল মাসুদের বিরুদ্ধে। অস্ট্রেলিয়া, জাপান, কানাডা এবং আফ্রিকার দেশগুলিকেও শামিল করেছিলাম। হাওয়া বুঝে পিছিয়ে থাকেনি আমেরিকা বা ব্রিটেন।’’
বিশেষজ্ঞদের মতে, চিনেরও মাপা হিসেব রয়েছে এই পদক্ষেপের নেপথ্যে। প্রথমত, মাসুদকে জঙ্গি তালিকায় তোলায় সায় দিয়ে ভারতের পরবর্তী সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্কের আবহ তৈরি করে রাখা যাবে মনে করছেন চিনা নেতৃত্ব। সেটা অত্যন্ত জরুরি, কারণ ভারতকে বাইরে রেখে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ বা ‘ওবর’-এর মতো মহা-যোগাযোগ প্রকল্পটি অসম্পূর্ণ হয়ে থাকছে। দ্বিতীয়ত, ভারতের বিরাট বাজার বরাবরই বেজিংয়ের কাছে পাখির চোখ। তবে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে এখন কিছুটা পাক-বিরোধী পদক্ষেপ করলেও, চিন যে সময় মতো ভারতের কাছে অন্য দাবি নিয়ে পাল্টা চাপ তৈরি করবে না— এমন আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, ‘উপহারের’ বদলে এ বার নিজেদের পাওনা আদায় করতে ঝাঁপাতে
পারে চিন।