জ়িদানের দেশ থেকে

ফুটবল,গান এবং সার্ত্র...

প্যারিসের জনপ্রিয় বার, ‘ল(ইন)কন্যুউ’-তে ঘটছে ব্যাপারটা, আর আমি বসে আছি তার পাশের রেস্তরাঁয়। আমার বান্ধবী এলোইস্-কে ফেলে রেখে দৌড়ে গিয়েছি দেখতে।

Advertisement

শ্রেয়স সরকার

প্যারিস শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৮ ০২:৫৯
Share:

প্যারিসের অলিতে-গলিতে। ছবি: এএফপি।

‘অ্যালে লে ব্লুউ, অ্যালে লে ব্লুউ......!’ প্রায়ান্ধকার বারের মধ্য থেকে আনন্দ কোলাহল হয়ে বেরিয়ে আসছে লাগামছাড়া ঝর্নার মতো।

Advertisement

নির্ঘাত গোল দিয়েছে!

প্যারিসের জনপ্রিয় বার, ‘ল(ইন)কন্যুউ’-তে ঘটছে ব্যাপারটা, আর আমি বসে আছি তার পাশের রেস্তরাঁয়। আমার বান্ধবী এলোইস্-কে ফেলে রেখে দৌড়ে গিয়েছি দেখতে। বিখ্যাত সস্তা বিয়ার ‘গালিয়া’ হাতে বেঁটে, লম্বা, রোগা, কালো, ফর্সা মুখগুলো প্রায় টিভির মধ্যে ঢুকে পড়বে, এ রকম অবস্থা!

Advertisement

সব ফরাসি। আধা-রসস্থ। এখন তারা গান শুরু করেছে। হঠাৎ এক ভদ্রলোক অত্যন্ত তটস্থ হয়ে ললিত ফরাসিতে বললেন, ‘‘আপনাকে বিরক্ত করছি না তো?’’

আমি বললাম, ‘‘না, মানে জিতে গিয়েছি আমরা, তাই তো?’’

‘‘জিতে গিয়েছি? উরুগুয়ের দম আছে আমাদের সঙ্গে লড়বার? ‘আমাদের আছে ভ্যালিয়ান্ট হার্ট’, বুঝলেন!’’ জ্যাক কিইর্-এর অসামান্য উক্তিটা উগরে দিয়ে ভদ্রলোক আবার মিলিয়ে গেলেন গান গাইবার দলে..!

এই হল আমার বতর্মান ঠিকানার চেহারা। প্যারিসে প্রায় আড়াই বছর হয়ে গেল এবং ন্যানো-টেকনোলজিতে পিএইচডি শুরু করতে করতে মনে হয়েছে, সব ক্ষেত্রেই এঁরা একটু বেশি রকমের উদ্বেল আর রুচিশীল। হ্যাঁ, ‘ইউরোপীয় বাঙালি’ বললে খুব ভুল হবে না! এই যেমন ফুটবল। ফুটবল এঁদের কাছে ‘লিবার্টি’।

মুক্তিসাধনের ঠিকানা।

ফ্রান্সের নীতিবাণীই তা-ই। সর্বদা সাম্যের খোঁজ। ফুটবল তথা যে কোনও দলগত খেলা তো তা-ই। সেখানে সবাই কোথায় যেন এক। ফ্রান্স এই ব্যাপারটা তুলনাহীন ভাবে আত্মস্থ করেছে। সেই ১৯৯৮-এ বিশ্বকাপ জয়ের পরে ফুটবল পেল প্রায় রূপকথার চেহারা। প্যারিসে, লিয়ঁতে বড় বড় ক্লাব। অবশ্য বিশ্বকাপের সঙ্গে এদের যোগাযোগ সেই জুলে রিমের হাত ধরে, যাঁর নামে বিশ্বকাপ ট্রফির নামকরণ হয়েছিল।

গত কয়েক বছরের ব্যর্থতার পর, এ বারের বিশ্বকাপে ফ্রান্সের উপরে আস্থা রেখেছেন দেশের মানুষ। এমনকি প্রেসিডেন্ট মাকরঁ ‘দারিদ্র দূরীকরণ কর্মসূচি’ স্থগিত রেখে রাশিয়া ছুটবেন দলকে সমর্থন করতে। এর জন্য বিরোধীরা তাঁকে ‘বড়লোকদের প্রেসিডেন্ট’ বলে খোঁচাও দিচ্ছেন। কিন্তু মাকরঁ অটল। এ বার ফ্রান্স অনেক দূর যাবে, ভেবেছিলেন অনেকেই। যদিও ল্যাকাজেত, কোমান, রাবিওতের মতো বড় খেলোয়াড়দের নেননি কোচ দিদিয়ের দেশঁ। অনেকের ধারণা, দেশঁ খেলোয়াড় হিসেবে যে রকম পয়মন্ত, প্রশিক্ষণেও তেমনই সৌভাগ্যশালী। অধিনায়ক হিসেবে তিনি বিশ্বকাপ দিয়েছিলেন, এ বার সেমিফাইনালে ওঠার পর-পরই ‘বিশ্বজয়ী’ বলা হচ্ছে তাঁকে। তাঁর কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে মতভেদ আছে অবশ্য। আমি-আপনি, কেউই এ সব ধারণা বদলাতে পারব না।

কারণ, ফরাসিদের সঙ্গে তর্ক করা বিষম বিড়ম্বনা। প্রায় বাচিক শিল্পীদের ঢঙে এঁরা এমন ভাবে বক্তব্য সাজিয়ে বসবেন (যার মধ্যে থাকবে গবেষণা, প্রত্যুত্তর এবং পরবর্তী সংশ্লেষণ) যে, সেখানে প্রবেশের কোনো পথই নেই। পুরো আলোচনাটাই একটি বৃত্ত!

জনতার নয়নের নতুন মণি অবশ্য কিলিয়ান এমবাপে। জ্বলজ্বল করছেন জ়িনেদিন জ়িদান, পল পোগবাও। এই দু’টো নাম প্রায় বিদ্যুতের মতো কাজ করে। সবাই বলেন, পোগবার এ বার নেতৃত্ব নেওয়া উচিত। যে দিন ফ্রান্স-উরুগুয়ে ম্যাচ ছিল, সে দিন আমায় ওঁর ছবি পাঠিয়েছিল বন্ধু লরোঁ। পরনে সাদা পোশাক, হাতে বিখ্যাত পেস্ট্রি-শেফ পিয়ের হার্মের তৈরি নীল-সাদা-লাল ম্যাকারন। এই মিষ্টি পিয়ের হার্মে নিজে তৈরি করেছিলেন কোয়ার্টার ফাইনাল উপলক্ষে।

সব ধরনের নন্দনশৈলী, সর্বোপরি খাদ্যের নান্দনিকতা উদ্‌যাপন এঁদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত। খেলার ক্ষেত্রেও সেটা সমান প্রযোজ্য। বলতে ভুলে গিয়েছি, সে দিন বারের এক কোণায় একটি অল্পবয়সি ছেলে ছিল। হাতে সার্ত্রর ‘অস্তিত্ববাদ’। এই চরম হট্টগোলের মধ্যে ও রকম ভারী দর্শনের বই পড়ছে কী করে? জিজ্ঞাসা করতে বলল, ‘‘দর্শন তো মানুষের। মানুষের থেকে আলাদা হয়ে পড়া যায়? আমার অস্তিত্বের কারণ তো এখানেই, ক্রীড়ার মাঝে, রাজনীতির মাঝে, কোলাহলের মাঝে!’’

রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত উক্তি ‘বহু জনতার মাঝে অপূর্ব একা’-র একটি ভিন্ন ব্যাপ্তি বলে মনে হল। নাহ্, এ দেশের হবে। যে দেশের শহরে শহরে গাছ থেকে বই ঝোলানো হয়, ভিক্ষাজীবীরা বই পড়ে আর ক্রীড়ার অনন্য দর্শন আছে— সে দেশ এই বিশ্বকাপ যদি না-ও জেতে, জিতে গিয়েছে কোথাও না কোথাও!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন