গাজার এক হাসপাতালের মর্গে জাদল্লা। ছবি: এ পি।
বরফ ঠান্ডা একটা রেফ্রিজারেটর। ভিতরে ঠাসা আস্ত একটা পরিবার। দাদু, ঠাকুমা, বাবা, মা-র সঙ্গে একটা বছর চারেকের শিশুও। নিথর। প্রত্যেকেরই চোখে মুখে স্থির হয়ে যাওয়া একটা আতঙ্ক। বৃহস্পতিবার ইজরায়েলি হামলায় নিমেষে খতম একটা পরিবারের তিন-তিনটে প্রজন্ম। শুক্রবারই ঠিকানা বদল। গাজার জেবালিয়া উদ্বাস্তু শিবির থেকে সরাসরি বেইত লাহিয়ার হাসপাতাল-মর্গে। চারিদিকে স্বজন হারানোর আর্তনাদ। শুধু এক জনই আপাত ভাবলেশহীন। ওই রেফ্রিজারেটরের মতোই বরফ ঠান্ডা। বয়স ৭৫, নাম জাদল্লা। পেশায় ডোম। আপাতত তাঁর একটাই ঠিকানা কামাল আদওয়ান হাসপাতাল-মর্গ। ছোট্ট একটা ঘর। তিনটে রেফ্রিজারেটর। একটা কাঠের টেবিল। আর লাশের ওপর ঢাকা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হাজার হাজার কাফন ডোরাকাটা, ধপধপে, সাফসুতরো।
ইজরায়েলি হামলার ১৮তম দিনে আজ গাজায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৩২। নিহত অন্তত ১৯০টি শিশু। আহত ৫ হাজার ২৪০। সংঘর্ষ বিরতির কোনও ইঙ্গিত নেই। মৃত্যুমিছিলের সঙ্গে তাই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জাদল্লার ব্যস্ততাও। যুদ্ধে নিহত প্যালেস্তাইনি ‘শহিদদের’ কবরে শোয়ানোর আগে শেষ ‘মেক-আপের’ ভার একা বৃদ্ধের হাতে।
দেখা গেল, অভ্যস্ত হাতে ফ্রিজ থেকে একটা-একটা করে লাশ বের করছেন জাদল্লা। তার পর কাঠের টেবিলে শোয়াচ্ছেন। যত্ন করে মুখটা মুছিয়ে কাফন পরাচ্ছেন প্রতিটি শরীরে। শুধু টেবিলে কোনও শিশু এলেই, ক্ষণিকের জন্য হলেও হাত কাঁপছে বৃদ্ধের। ওয়েটিং রুমে অপেক্ষায় নিহতের আত্মীয়রা। ভিড়ে মিশেছিলেন সদ্য বিধবা এক মহিলাও। পাগলের মতো চিৎকার করছিলেন। জাদল্লা নিজেই মহিলাকে ভেতরে নিয়ে এলেন। দাঁড়ালেন ফ্রিজের পাল্লা খুলে। ঠান্ডা নিথর স্বামীকে দেখেই জ্ঞান হারালেন সদ্য বিধবা।
চোখ চিকচিক করে ওঠে জাদল্লারও। বললেন, “গত তিরিশ বছর ধরে এই কাজটাই করে আসছি। কিন্তু এরকম নৃশংস সেনা হামলা আগে কখনও দেখিনি। যুদ্ধে যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁদের জন্নতের জন্য প্রস্তুত করে দেওয়াটা আমার কাজ।”
১৯৩৯-এ জন্ম জাদল্লার। ১৯৪৮-এ পশ্চিম এশিয়ার যুদ্ধের সময়ই সপরিবার গাজায় চলে আসেন। পাকাপাকি ভাবে থাকতে শুরু করেন জেবালিয়া উদ্বাস্তু শিবিরের কাছেই। প্রথমে ব্যবসা করতেন। ১৯৮০ নাগাদ ধর্মের তাগিদেই স্বেচ্ছায় এই কাজ বেছে নেন তিনি। তাঁর কথায়, “হাজারেরও বেশি শহিদের শরীরে কাফন পরিয়েছি এত দিন। পুণ্য করছি বুঝতে পারি। কিন্তু এই মৃত্যুমিছিল আর সহ্য করতে পারছি না।”
নিজেরও ছ’টি সন্তান তাঁর। সাফ জানালেন, “ইজরায়েলকে ক্ষমা করার কোনও প্রশ্নই উঠছে না। ১৭ লক্ষ লোক বাস করে গাজায়। সাত বছর ধরে সীমান্ত প্রায় বন্ধ করে রেখেছে মিশর আর ইজরায়েল। এমনিতেই দমবন্ধ। তার পর আবার ইজরায়েলের হামলা। এর থেকে কি মুক্তি নেই?”
এই প্রশ্নের আপাতত উত্তর নেই। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে নতিস্বীকারে নারাজ দু’পক্ষই। ইজরায়েলের অভিযোগ, আজ সকালেই তেল আভিভের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরে তিনটি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে হামাস। এ দিকে, আজই গাজায় ইজরায়েলি হানার বিরোধিতা করে প্যালেস্তাইনের পাশে থাকার ইঙ্গিত দিল ইরান।
সংঘর্ষ বিরতি নিয়ে আজই বৈঠকে বসার কথা ইজরায়েলি প্রশাসনের। গত কাল রাষ্ট্রপুঞ্জ পরিচালিত গাজার একটি স্কুলে ইজরায়েলি রকেট হামলায় ১৫ জনের প্রাণ যাওয়ার পরই ফের জোরকদমে শান্তি প্রস্তাবের দাবি উঠছে নানা মহল থেকে। মার্কিন বিদেশসচিব জন কেরি অন্তত দিন দশেকের সংঘর্ষ বিরতির দাবি নিয়ে বিশেষ বৈঠকে বসতে পৌঁছে গিয়েছেন তুরস্কে। রাষ্ট্রপুঞ্জ আজ জানিয়েছে, গাজার বিভিন্ন ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন অন্তত এক লাখ মানুষ। খাদ্য সংকটে ভুগছেন সকলেই।
অন্তরে সংকট নিয়েও কর্তব্যে অবিচল শুধু জাদল্লা।