পাপা। পুরো নাম লিখলে আপত্তি কী? “কী দরকার? নামে কী আসে যায়?”
মুম্বই থেকে ইস্তানবুল। তার পরে অন্য বিমানে আথেন্স। নেমেই মনে হল টাইম মেশিনে চড়ে ষাট বছরে পিছনে চলে গিয়েছি। বিশ্বমানের তুলনায় পুচকে এয়ারপোর্ট থেকে বাইরে আসতেই ছ’ফিটের উপরে লম্বা একটি লোকের পাঞ্জার মধ্যে আমার হাতটা হারিয়ে গেল। এর পরে যত না আথেন্সের দ্রষ্টব্য দেখেছি তার থেকেও বেশি বিভিন্ন পানশালায় পাপার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরেছি।
সবার কাছে প্রশ্ন একটাই। “ভারত কী করে পারল বলুন তো?” সরকারি অধিকার থেকে অর্থনীতিকে বাজারের হাতে তুলে দেওয়ার সাফল্য ওঁদের কাছে এক বিস্ময়। রাগ জার্মানি আর দেশের নেতাদের উপর। বিশ্বযুদ্ধের সময় যে সোনা নিয়ে গিয়েছে জার্মানরা তা যদি দেশে থাকত তা হলে না কি এই সমস্যা হত না। আর নেতারা যদি টাকা না মারত তা হলেও নাকি এতটা সমস্যা হত না। সাধারণ মানুষ আজ খেসারত দিচ্ছে এই সবেরই।
দু’বছর আগেই বেকারত্ব ২৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। চাকরি নেই। ছেলেরা খাচ্ছে বাবার অবসর ভাতার টাকায়। যাদের গ্রামে বাড়ি, তাঁদের অবস্থা কিছুটা ভাল। গ্রাম থেকে টাকা আসে। কিন্তু গ্রামের লোক শহরে বাড়ি করলে নতুন নিয়মে যে কর দিতে হয় তাতে নাভিঃশ্বাস ওঠে। পাপা ভাগ্যবান। অ্যাক্রোপলিস থেকে নেমেই প্লাকা। বনেদি বড়লোকের জায়গা। পানশালায় ‘জোরবা দ্য গ্রিক’-এর বাজনার তালে পা মেলাচ্ছেন ছেলে বুড়ো সবাই। পাপার বাড়ি এই বইয়ের লেখক নোবেলজয়ী নিকস কাজানজাকিসের বাড়ির কাছে, ওই প্লাকাতেই। বিশ্বজুড়ে সম্পত্তি। গাইডের কাজ করেন শখে। পেশায় ইন্টিরিয়র ডিজাইনার। বেঙ্গালুরুতেও আসেন কাজে। পাপার আর্থিক সমস্যা নেই। কিন্তু তাঁর বন্ধু ছাঁটাই হওয়ার দলে। বাবার পেনশনে খাচ্ছেন। তাঁর দাবি, স্কুলের ছেলেরা বাসে উঠে ভিক্ষা করে টিফিনের পয়সার জন্য। কারণ তাঁদের বাবাদের চাকরি নেই। দাদুর পেনসনের টাকায় সংসার চলছে না।
এর এই সমস্যাটাকেই কাজে লাগিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাস। তাঁর জায়গায় অন্য কেউ এলেও যে ঘটনাটা অন্য রকম ঘটত তাও বলা যাচ্ছে না। কারণ, নতুন ঋণের শর্ত রাজনৈতিক ভাবে গ্রিসের কোনও নেতার পক্ষেই মেনে নিয়ে রাজত্ব করা হয়ত সম্ভব হত না। আর তা ছাড়া সিপ্রাস তো জিতেছিলেন এই প্রতিশ্রুতিতেই যে তিনি আর কাটছাঁটের রাস্তায় হাঁটবেন না।
ভারতের রাস্তায় হেঁটে, অর্থাৎ সময় নিয়ে সংস্কারের রাস্তায় হাঁটলে — হয়ত আজকের বিশ্বকাঁপানো এই ভোট এড়ানো যেত। কিন্তু গ্রিসের ঋণের শর্ত এই সুযোগ দেয়নি।
গ্রিস সামরিক শাসন থেকে মুক্ত হয় ১৯৭০ সালে। ১৯৭৩ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১৮ শতাংশ। অর্থনীতিকে চাগাতে ঘাটতি বাজেটকেই হাতিয়ার করে সরকার। এর একটা বড় অংশ যায় অদক্ষতায় ন্যুব্জ সরকারি সংস্থায়। ঘাটতির অর্থ আসে বাজার থেকে ২৪.১৩ শতাংশ সুদে। তুলনার জন্য যদি দেখি তা হলে সেই সময় একই সমস্যায় ভোগা ইতালি বাজার থেকে টাকা তুলেছে ১৩.২৮ শতাংশ হারে।
২০০২ সালে দ্রাখমা ত্যাগ করে ইউরোকে মেনে নেয় গ্রিস। এতে মূল্যস্ফীতি কমে এসেছে, বৃদ্ধির হার বেড়েছে বলে সরকার দাবি করতে শুরু করে। ২০০৯ সালে গ্রিস মেনে নেয় যে আর্থিক উন্নয়নের যে দাবি তারা করে আসছিল তা আসলে মিথ্যা। ঘাটতি আসলে ১২.৬ শতাংশ। ছয় শতাংশের দাবি ভুল!
প্রশ্ন ছিল, ভারত পারল গ্রিস পারল না কেন? ১৯৯০ সালে ভারতের কোষাগার যখন মুখ থুবড়ে পড়ে তখন সংস্কার ছাড়া পথ ছিল না। বামেরা ছাড়া সবাই এটা মেনে নেওয়ায় বাজার অর্থনীতির রাস্তায় পা ফেলতে শুরু করে ভারত। কাজটা সহজ হয়নি, তা আমরা সবাই জানি। সংস্কারের কাজ এখনও চলছে। কিন্তু গ্রিস এই রাস্তায় হাঁটেনি। ঋণ করেই ঘি খাওয়ার ভবিষ্যৎ আজ বাস্তব। ২০১০ সালে ইউরোপিয়ন সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক (ইসিবি), আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার (আইএমএফ) এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) মিলিত ভাবে ঋণ দেয় গ্রিসকে। ঋণের পরিমান এখন জাতীয় আয়ের ১৭৫ শতাংশ দাঁড়িয়ে। মূল শর্ত ছিল বাজারমুখী সংস্কার এবং পেনশনের হার কমানো। সমালোচকদের দাবি, ২০ বছরের মধ্যে সংস্কারের রাস্তায় গ্রিসের পক্ষে অর্থনীতিকে চাঙ্গা রেখে এই ঋণ শোধ করা সম্ভব নয়। লাগবে অন্তত ৪০ বছর, এবং আরও ঋণ। এবং পেনশন কমালে রাজনৈতিক ভাবে এই সমস্যার মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। বাজারমুখী সংস্কার দ্রুত করতে গেলে বৃদ্ধির হার কমবে। জাতীয় আয় কমলে গ্রিসের পক্ষে ঋণ শোধ করাও সম্ভব হবে না। এই সমালোচনা কিন্তু আজকের নয়। দু’বছর আগে থেকেই অনেকেই এটা বলতে শুরু করেছিলেন। এবং তা কতটা সত্যি তার প্রমাণ গতকালের গণভোটের রায়ে।
এবার কী হবে? এর কোনও স্পষ্ট উত্তর হাতের কাছে নেই। সাত জুলাই পর্যন্ত গ্রিসে ব্যাঙ্কে বন্ধ। আপৎকালীন ঋণ ব্যবহার করে ২০ তারিখ পর্যন্ত চলবে। তার পরে ৩৫০ কোটি ইউরো ঋণ শোধ দিতে হবে ইসিবি-কে। না পারলে গ্রিস দেউলিয়া ঘোষিত হবে। গ্রিসকে ইউরো ছেড়ে দ্রাখমায় ফিরে নতুন করে শুরু করতে হবে। কিন্তু আইনমাফিক ইউরো থেকে গ্রিস কী ভাবে বেরবে তা কেউ জানে না, কারণ এই নিয়মটাই তৈরি করেনি ইউরোপিয়ন ইউনিয়ন!
বিশ্ববাজারে কী হবে? অনিশ্চয়তার আঁচ লাগবে। কিন্তু ঠিক কতটা তা কেউ বলতে পারছে না। তবে এটা ঠিক একই ঘটনা ঘটতে চলেছে পুয়েরতো রিকোতে। সেখানেও যদি ঋণ খেলাপির ঘটে তা হলে বিশ্ব বাজারে ঋণের শর্ত কড়া হবেই। তার আঁচ ভারতের অর্থনীতিও এড়াতে পারবে না। কতটা? তা এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে আজ ই ইউ বৈঠকে বসবে। গ্রিস নিয়ে। দিনের শেষে বোঝা যাবে জল কোন দিকে গড়াচ্ছে। সিপ্রাসও চান না পূর্ণ বিচ্ছেদ। সিপ্রাসের অর্থমন্ত্রী (এখন প্রাক্তন) অর্থনীতিবিদ্, গেম থিয়োরি বিশেষজ্ঞ। যাওয়ার আগে তাঁর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বোরে খেলেছেন। এখন দেখার আজ দিনের শেষে জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মর্কেল-এর নেতৃত্বে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ান পাল্টা কী চাল দেয়।