CIA Nuclear Generator in Nanda Devi

তুষারে তেজস্ক্রিয়তার ছাপ, ৬০ বছর ধরে নন্দাদেবীতে ‘লুকিয়ে’ সিআইএ-র পরমাণু জেনারেটর! কী সেই শীতল যুদ্ধের রহস্য?

ভারতে হামলা চালানোর দু’বছর পরে ১৯৬৪ সালে লপ নুর হ্রদে পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা করেছিল চিন। এর ফলে একই সঙ্গে চিন্তায় পড়েছিল ভারত এবং আমেরিকা। সে সময়ই পেন্টাগন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, বেজিঙের সমস্ত পরমাণু গতিবিধির উপর নজরদারি চালানো হবে।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২৫ ২১:৩০
Share:

নন্দাদেবী পর্বতের যেখানে হারিয়ে গিয়েছে সিআইএ-র পরমাণু শক্তি চালিত জেনারেটর। ছবি: নিউ ইয়র্ক টাইমস।

৬০ বছর আগে হিমালয়ের ২৫ হাজার ফুট উচ্চতায় বরফে ঢাকা গিরিশিরায় গুপ্ত অভিযানে ঘটেছিল বিপত্তি। যে রহস্যের জাল আজও উন্মোচিত হয়নি পুরোপুরি। ১৯৬৫ সালে চিনের পরমাণু কর্মসূচি ও সামরিক গতিবিধির উপর নজরদারির উদ্দেশ্যে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ নন্দাদেবীর শিখরে একটি পরমাণু শক্তি চালিত জেনারেটর স্থাপন করেছিল। এই অভিযানে আমেরিকা ও ভারতীয় পর্বতারোহীরা অংশ নেন। তবে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে প্লুটোনিয়াম চালিত জেনারেটরটি সেখানে ফেলে রেখে যেতে হয়েছিল। এর পরে ছ’দশক পেরিয়ে গেলেও এর সম্ভাব্য পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ রয়ে গিয়েছে।

Advertisement

ঝাড়খণ্ডের বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে নিখোঁজ প্লুটোনিয়াম ডিভাইসটি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর প্রশ্ন ছিল— হারিয়ে যাওয়া পরমাণু নজরদারি যন্ত্র থেকে ছড়ানো তেজস্ক্রিয়তার জেরেই কি দ্রুত গলছে হিমবাহ? হড়পা বান, ধসে বিপর্যস্ত হচ্ছে একের পর এক জনপদ? ক্যানসারের প্রকোপ বাড়ছে গঙ্গা নদীর অববাহিকা জুড়ে? হিমালয়ের বুকে চাপা পড়ে থাকা শীতল যুদ্ধের নিখোঁজ রহস্যের সন্ধান করা প্রয়োজন বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।

ষাটের দশকের গোড়ায় আমেরিকা-রাশিয়া ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ই ১৯৬২ সালে ভারতে আচমকা হামলা করেছিল চিন। তার কিছুদিন আগে মাও জে দঙের সেনা আগ্রাসন চালিয়ে গ্রাস করে নিয়েছিল স্বাধীন রাষ্ট্র তিব্বত এবং ইস্ট তুর্কিস্তান (বর্তমান নাম শিনজিয়াং)-কে। ১৯৬৪ সালে শিনজিয়াং প্রদেশের লপ নূর হ্রদে পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা করেছিল চিন। ফলে একই সঙ্গে চিন্তায় পড়েছিল ভারত এবং আমেরিকা। সে সময়ই পেন্টাগন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, বেজিঙের সমস্ত পরমাণু গতিবিধির উপর নজরদারি চালানো হবে। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসাবেই ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা আইবি-র এই যৌথ উদ্যোগে নন্দাদেবীতে প্লুটোনিয়াম চালিত যন্ত্র বসানো হয়েছিল। এই অভিযানের পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন হ্যাট’।

Advertisement

ওই নজরদারি যন্ত্র বসানোর জন্য তিব্বত মালভূমির লাগোয়া এমন একটি পর্বতশৃঙ্গের প্রয়োজন ছিল, যেখানকার উচ্চতা বেশি এবং যেখানে দৃশ্যমানতায় কোনও বাধা পড়বে না। এর পরেই বেছে নেওয়া হয় নন্দাদেবীকে। যার উচ্চতা ২৫৬৪৩ ফুট (৭৮১৫ মিটার)। যন্ত্রটির ওজন ছিল প্রায় ৫৬ কিলোগ্রাম। এত ভারী একটি যন্ত্র নন্দাদেবীর চূড়ায় তোলা তখনকার দিনে সহজ কাজ ছিল না। এতে ব্যবহৃত প্লুটোনিয়ামের পরিমাণ ছিল হিরোশিমায় ব্যবহৃত পরমাণু বোমায় ব্যবহৃত প্লুটোনিয়ামের অর্ধেক। যন্ত্রটি বসানোর জন্য লাগত একটি ১০ ফুটের অ্যান্টেনা, দুটো রেডিয়ো এবং একটি বিশেষ ধরনের জেনারেটর। এই জেনারেটরটি চালু রাখার কাজে ব্যবহার করা হত প্লুটোনিয়াম।

এই কাজ করার জন্য ১৪ জন পর্বতারোহীর একটি বিশেষ দল গঠন করা হয়। সকল পর্বতারোহীকে ওই সময় এক হাজার ডলার মাসিক বেতন দেওয়া হয়। ওই দলে ছিলেন আমেরিকার পর্বতারোহী রবার্ট শ্যালার, টম ফ্রস্ট এবং জিম ম্যাকার্থি। ভারতের তরফ থেকে ছিলেন ক্যাপ্টেন এমএস কোহলি, সোনম ওয়াঙ্গাল, এইচসিএস রাওয়াত এবং জিএস রাঙ্ঘু। এই চার জন ১৯৬৪ সালে ভারতের এভারেস্ট অভিযাত্রী দলের সদস্য ছিলেন। ক্যাপ্টেন এম এস কোহলিকে সিআইএ এবং আইবি-র এই যৌথ অভিযানকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নির্বাচিত করা হয়। কোহলি পরে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন তাঁর দলের অভিযাত্রীর এই অভিযানের ব্যাপারে পুরো জানতেন না। শুধু জানতেন একটি যন্ত্রকে নন্দাদেবীর চূড়ায় তুলতে হবে। ১৯৬৫ সালের অক্টোবর মাসে সাতটি প্লুটোনিয়ামের ক্যাপসুল এবং কিছু নজরদারি যন্ত্র নিয়ে ‘স্বর্গের সিঁড়ি’ নন্দাদেবীর উদ্দেশে রওনা দেয় অভিযাত্রীদল। অভিযানের গোপনীয়তা বজায় রাখতে কোনও রকম হেলিকপ্টার বা বিমানের সাহায্য নেওয়া হয়নি।

প্রবল ঠান্ডা, ভয়ঙ্কর উচ্চতায় অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়া, সঙ্গে ৫৬ কেজির ভারী যন্ত্র— সব মিলিয়ে অভিযাত্রীদের কাছে পরিস্থিতি ছিল বেশ প্রতিকূল। ক্যাপ্টেন কোহলি জানান, দলের সুরক্ষাই তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল। চূড়ার কাছে পৌঁছোতেই প্রবল হাওয়া এবং তুষারঝড়ের দরুন আবহাওয়া প্রতিকূল হতে শুরু করে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে পারমাণু জেনারেটর-সহ নজরদারি যন্ত্রকে চূড়ার নীচে একটি গুহার মতো পাথুরে ফাটলে রেখে নীচে নেমে আসে অভিযাত্রীদল। কিন্তু পরের বছর অভিযাত্রীদল ওই জায়গায় গিয়ে দেখে, সেখান থেকে গায়েব হয়ে গিয়েছে যন্ত্রটি। এই খবরে চাপে পড়ে যান সিআইএ এবং আইবির কর্তারা। তাঁরা জানতেন এই যন্ত্রে থাকা প্লুটোনিয়াম কোনও ভাবে প্রকৃতিতে মিশে গেলে জীবন বিপন্ন হতে পারে নন্দাদেবীর নিকটবর্তী জনবসতির বাসিন্দাদের। কিন্তু গুপ্তচরবৃত্তিতে ঢিলে দেওয়া হয়নি। ১৯৬৭ সালে নন্দাকোট পর্বতে অনুরূপ একটি যন্ত্র বসায় দুই গোয়েন্দা সংস্থা এবং নিশ্চিত হয় যে চিনের কাছে কোনও রকম দূরপাল্লার পরমাণু অস্ত্রবহনক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র নেই।

সিআইএ-র তরফে হারানো যন্ত্রের খোঁজে ১৯৬৮ সালে দু’টি অত্যাধুনিক হেলিকপ্টার আনা হয়েছিল ভারতে। ওই হেলিকপ্টার দু’টি ৩৪ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়তে পারত। তেজস্ক্রিয়তা চিহ্নিতকারী যন্ত্রও ছিল কপ্টারে। কিন্তু কোনও ফল মেলেনি। এর পরেও নন্দাদেবীতে বেশ কয়েকটি অভিযান চালানো হয়। কিন্তু যন্ত্রটির খোঁজ মেলেনি। অনেকে মনে করেন, তুষারধসের কারণে নন্দাদেবীতে হারিয়ে গিয়ে থাকতে পারে পারমাণু যন্ত্রটি। কিন্তু সেটিতে থাকা প্লুটোনিয়ামের আয়ু ১০০ বছর। অর্থাৎ, আগামী ৩০-৪০ বছর পর্যন্ত এটি বিপদ তৈরি করার ক্ষমতা রাখে। অনেকে মনে করেন ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে উত্তরাখণ্ডের চামোলীতে হড়পা বানের জন্য এই যন্ত্রই দায়ী। নন্দাদেবীতে হিমবাহের ভাঙনের ফলে ঋষিগঙ্গা এবং ধৌলিগঙ্গার জলস্তর আচমকা অনেকটা বেড়ে যায়। এর ফলে চামোলীতে হড়পা বানের সৃষ্টি হয়। এর ফলে প্রায় ৮২ জনের মৃত্যু হয়, নিখোঁজ হন ২০০ জন। এই হড়পা বানে ঋষিগঙ্গা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং এনটিপিসির তপোবন জলবিদ্যুৎ প্রকল্প প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যেখানে হিমবাহের ভাঙন ধরেছিল তার কাছেই ১৯৬৫ সালে হারিয়ে গিয়েছিল সিআইএ-র ওই পরমাণু জেনারেটর।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement