নয়া পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষমতায় আসেন ইমরান।—ফাইল চিত্র।
যেন চক্রব্যূহ এক। ঢুকে পড়েছেন তিনি যে ভাবেই হোক। কিন্তু বেরনোর পথ নেই। রাজনীতি, কূটনীতি বা রণনীতি— কোনওটাতেই সুবিধা করে উঠতে পারছেন না। সব ফ্রন্টেই ব্যাকফুটে। এমন ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিপাকের মাঝে দাঁড়িয়ে ইমরান খান আর রাষ্ট্রপ্রধানের ভঙ্গিতে খেললেন না। ফিরে গেলেন নিজের ক্রিকেটীয় ভঙ্গিতে। প্রবল চাপের মুখেই হোক বা অন্য কোনও কারণে, একেবারে ছকভাঙা পদক্ষেপ করলেন। ঝুঁকি ছিল প্রবল। কিন্তু ঝুঁকিটা নিলেন বলেই নিজের রাজত্বে আজ বেশ স্বস্তিতে পাক শাসক।
‘নয়া পাকিস্তান’— নির্বাচনী স্লোগান ছিল ইমরান খানের। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে নিজের দেশে তো বটেই, নানা আন্তর্জাতিক মঞ্চেও ‘নয়া পাকিস্তান’-এর ধারণাটা তুলে ধরতে ইমরান খান তৎপর হয়েছিলেন। কিন্তু কথা আর কাজ মিলছে না। পাকিস্তানের ভূমিকে সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর হিসেবে অবাধে ব্যবহৃত হতে দেওয়া— ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে অনেকগুলো বছর ধরেই মূল অভিযোগটা এই। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদে বসার পর থেকে ইমরান খান একবারের জন্যও প্রমাণ করতে পারেননি যে, তাঁর ‘নয়া পাকিস্তানে’ সন্ত্রাসের কোনও স্থান নেই। শুধু ভারত নয়, আফগানিস্তান, ইরানও বার বার আক্রান্ত হচ্ছিল পাকিস্তানে ঘাঁটি গেড়ে থাকা জঙ্গিদের হাতে।
এ জন্য পাকিস্তানকে খেসারত দিতে হচ্ছিল না, এমন নয়। একের পর এক আন্তর্জাতিক সহায়তা হাতছাড়া হচ্ছিল, ব্যবসা প্রবল ভাবে মার খাচ্ছিল, বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার তলানিতে, অর্থনীতি মুমূর্ষু। শেষ ভরসা হিসেবে সৌদি আরবের মুখ চেয়ে যখন বসে রয়েছেন ইমরান, ঠিক তখনই জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ভয়াবহ জঙ্গিহানা হল এবং পাকিস্তানে আশ্রিত জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মহম্মদ সদর্পে তার দায় স্বীকার করল।
পাক পার্লামেন্টে ইমরান খান।—ফাইল চিত্র।
আরও পড়ুন: ভারত নিয়ে অবস্থান পাল্টাচ্ছে চিন? পুলওয়ামা কাণ্ডের পর উঠছে প্রশ্ন
লহমায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে গিয়েছিল ইমরান খানের জন্য। ভারত সামরিক পদক্ষেপ করবেই— বার বার স্পষ্ট করে ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কূটনৈতিক ভাবে পাকিস্তানকে আরও কোণঠাসা করার প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছিল নয়াদিল্লি। সৌদি যুবরাজ কাটছাঁট করে দিয়েছিলেন তাঁর পাকিস্তান সফর। ভারতের তীব্র কণ্ঠস্বরের জবাব দেওয়ার দাবি প্রবল হচ্ছিল পাকিস্তানের অন্দরে। ইমরান অবশেষে জাতির উদ্দেশে ভাষণ (আসলে ভারতের উদ্দেশে) দিয়ে জানিয়েছিলেন, ‘‘ভারত আঘাত করলে, পাকিস্তান প্রত্যাঘাতের কথা ভাববে না, প্রত্যাঘাত করবে। পাকিস্তানের সামনে তা ছাড়া আর কোনও রাস্তা থাকবে না।’’
পাক প্রধানমন্ত্রীর হুমকি কিন্তু ভারতকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। ২৬ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে পাকিস্তানে ঢুকে বোমাবর্ষণ করে আসে ভারতীয় বায়ুসেনা। বুধবার সকালে ভারতীয় আকাশসীমা লঙ্ঘন করে পাক বায়ুসেনা। পাক বাহিনীর একটি এফ-১৬ ধ্বংস করে ভারত। ভারতীয় মিগ-২১ বাইসনও পাক প্রত্যাঘাতে বিধ্বস্ত হয়। সেই যুদ্ধবিমানের পাইলট তথা ভারতীয় বায়ুসেনার উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানই প্যারাশুটে করে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে নামতে বাধ্য হন।
উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমান পাকিস্তানে আটকে পড়ায় কিছুটা হলেও অস্বস্তি বেড়েছিল ভারতের। তাঁর মুক্তির জন্য বুধবার থেকেই তৎপর হয়েছিল ভারত। অবিলম্বে এবং নিঃশর্তে ভারতীয় পাইলটকে মুক্তি দিতে হবে বলে ভারত জানিয়েছিল। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কিছুটা চমকে দিয়েই পাকিস্তানের আইনসভায় ইমরান খান ঘোষণা করেন, শুক্রবার ভারতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে অভিনন্দন বর্তমানকে।
অভিনন্দন বর্তমানকে নিয়ে তখন আলোচনায় ব্যস্ত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।—ফাইল চিত্র।
আরও পড়ুন: মৃত সেজে শুয়ে থাকা জঙ্গির গুলিতে কাশ্মীরে নিহত চার জওয়ান-সহ পাঁচ
ইমরানের এই ঘোষণাই কিন্তু মুহূর্তে বদলে দিয়েছে পরিস্থিতি। ওই ঘোষণার খবর ভারতের আসার আগের মুহূর্ত পর্যন্তও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দফতরে বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রকে তৎপরতা ছিল তুঙ্গে। তিন বাহিনীর প্রধানরা যৌথ সাংবাদিক সম্মেলন করবেন বলে জানানো হয়েছিল। দফায় দফায় বৈঠক করছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। অভিনন্দনের মুক্তির ঘোষণার খবর পৌঁছতেই থমকে যায় অনেক কিছুই। বড় পদক্ষেপের সম্ভাবনা নিয়ে কথাবার্তা স্থগিত হয়, সামরিক কর্তাদের সাংবাদিক সম্মেলন পিছিয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত যাঁরা মিডিয়ার মুখোমুখি হন, তাঁর তিন বাহিনীর সর্বোচ্চ পদাধিকারী নন।
বোঝাই যাচ্ছিল, উত্তেজনা প্রশমনের পথে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে আর কোনও বড় সামরিক পদক্ষেপের কথা যে ভারত ভাবছে না, তা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল। চক্রব্যূহে ফেঁসে থাকা ইমরান খানের কূটনৈতিক ‘রিভার্স সুইং’-এর সুবাদেই যে অনেকখানি সম্ভব হল এই প্রশমন, সে সম্পর্কে কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশারদদের অনেকেই একমত।
আটক করার ২৪ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই ভারতীয় বায়ুসেনাকে মুক্তি দেওয়ার কথা ঘোষণা করা কি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে খুব একটা সহজ কাজ ছিল? বিশেষ করে এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে? পাক কূটনৈতিক মহল বলছে, খুব কঠিন কাজ ছিল। ইমরান খান কতটা স্বাধীন ভাবে কাজ করেন আর কতটা সেনার প্রভাবে— তা নিয়ে নানা তত্ত্ব সুবিদিত। সেই পাক সেনা যখন ভারতের সঙ্গে সামরিক সঙ্ঘাতের মুখে দাঁড়িয়ে, তখন ভারতীয় বায়ুসেনার পাইলটকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত যে খুব সরল পথে নেওয়া যায়নি, তা বোঝার জন্য অবশ্য কূটনীতিক হওয়ার প্রয়োজনও পড়ে না। নিজের দেশের আইন সভায় যখন ইমরান ঘোষণা করছিলেন ভারতীয় পাইলটকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা, তখন তিনি এ-ও জানতেন না, তাঁর এই পদক্ষেপকে কী চোখে দেখবে পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ। পাক সংসদ ঘোষণাটা শুনেই টেবিল চাপড়ে সমর্থন জানিয়েছিল। পাকিস্তানের সাধারণ জনতাও প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণাকে ইতিবাচক ভাবেই নিয়েছেন বলে পাক সংবাদমাধ্যম অন্তত দাবি করছে।
পাকিস্তানে ধরা পড়ার পর অভিনন্দনের এই ছবি সামনে আসে।—ফাইল চিত্র।
আরও পড়ুন: দেশে ফিরে কোন কোন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে পারেন অভিনন্দন
পাকিস্তান কি রাতারাতি শান্তিকামী হয়ে উঠল? শান্তির বার্তা দিতেই ভারতীয় পাইলটকে মুক্তি দিচ্ছে পাকিস্তান— ইমরান খানের এই বিবৃতিই কি ধ্রুব সত্য? এই প্রশ্ন কিন্তু ভারতীয় কূটনীতিকরা তুলছেন। তার সঙ্গেই উঠছে আর একটা প্রশ্ন— যে কোনও উপায়ে শান্তির বার্তা দেওয়া ছাড়া অন্য কোনও পথ নেওয়া কি এই মুহূর্তে সম্ভব ছিল ইমরান খান বা জেনারেল কমর জাভেদ বাজওয়ার পক্ষে?
প্রশ্নটা অবান্তর নয়। ভারত বিরোধী সন্ত্রাসের বীজ পাকিস্তানে লালিত হলে ভারত যে আর চুপচাপ বসে থাকবে না, সে কথা নরেন্দ্র মোদীর সরকার খুব স্পষ্ট করেই বুঝিয়ে দিয়েছিল ইসলামাবাদকে। উরির পরে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, পুলওয়ামার পরে পাক ভূখণ্ডে বোমাবর্ষণ— ভারতের এই রূপ পাকিস্তানের কাছে অচেনা ছিল। কূটনৈতিক ভাবেও পাকিস্তানকে অত্যন্ত চাপে ফেলে দিয়েছিল ভারত। নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য-সহ পৃথিবীর প্রায় সব বড় শক্তিকে নিজেদের অবস্থানের বৈধতা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক। ফলে পাকিস্তানের উপরে আন্তর্জাতিক চাপ ক্রমশ বাড়ছিল। সারা বছরের বন্ধু চিন উদ্ধার করবে যে কোনও বিপদে— পাকিস্তানের এই বিশ্বাসও ভেঙে গিয়েছিল। কারণ ভারতের প্রত্যাঘাতের পরে পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ানোর কোনও ইঙ্গিত চিন দেয়নি। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার জন্য পাকিস্তানের উপরেই বরং চাপ বাড়িয়েছিল তারা। শান্তির পথে না হাঁটা ছাড়া আর কোনও রাস্তা অতএব পাকিস্তানের সামনে ছিল না, মনে করছে আন্তর্জাতিক মহলও।
এই সব তত্ত্বকে পাক কূটনীতিকরা যে পুরোপুরি অস্বীকার করছেন, এমন নয়। সবটা স্বীকার করেই বরং ইমরান ঘনিষ্ঠরা বলছেন— ত্রিমুখী চাপের মধ্যে থেকে দেশকে টেনে বার করলেন ইমরান। এক দিকে ছিল ভারতের দিক থেকে বড়সড় সামরিক পদক্ষেপ হওয়ার আশঙ্কা। আর এক দিকে ছিল প্রবল আন্তর্জাতিক চাপ। নিজের দেশে ছিল সেনাকে এবং জনসাধারণকে তুষ্ট রাখার দায়।
আরও পড়ুন: ইসলামিক দেশগুলির শীর্ষ বৈঠকে আমন্ত্রিত ভারত, বেরিয়ে গেল ক্ষুব্ধ পাকিস্তান
ক্ষমতার শীর্ষ অলিন্দে প্রায় আনকোরা যে ইমরান খান, তিনি এই মারাত্মক জট ছাড়ালেন কী ভাবে? খুব কাছ থেকে যাঁরা লক্ষ্য রাখলেন গোটা পর্বটায়, তাঁদের মত— রাজনীতিরচেনা ছকে সমাধানের চেষ্টা করলে ইমরান পারতেন না। রাজনীতির জুতোটা কিছুক্ষণের জন্য খুলে রেখে যেন নিজের ছেড়ে আসা স্পোর্টস শ্যু-টা পায়ে গলিয়ে নিয়েছিলেন ইমরান। দেশের আইনসভায় দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের একমাত্র বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেট ক্যাপ্টেন ঘোষণাটা করেছিলেন স্পোর্টসম্যান স্পিরিটের কৌশলে সওয়ার হয়ে। সেই ‘রিভার্স সুইং’-ই ঘুরিয়ে দিল পরিস্থিতি।