নির্বাচন কলিং বেল টিপলে তো ব্যস্ততা বাড়বেই! বসন্তে গ্রীষ্মের উষ্ণতা ছড়াবেই।
ঠিক এই অবস্থাই এখন বাংলাদেশে। সামনে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। তাই খুব ব্যস্ত নির্বাচন কমিশন। নতুন ভোটার তালিকায় ৪০ লক্ষ নতুন মুখ। সব মিলিয়ে ভোটার ১০ কোটিরও বেশি। বাদ সেধেছে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। এপ্রিলে পরীক্ষার সময়সূচিকে পাশ কাটিয়ে নির্বাচন করার প্রয়াস। মার্চের শেষে উপকূল এলাকার ৭৪৭ ইউনিয়ন পরিষদ বা ইউপি’তে ভোট হচ্ছে। দেরি করার উপায় নেই। তাদের মেয়াদ ফুরোচ্ছে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই। যে করেই হোক, তার আগেই ভোট করতে হবে।
বাকি ইউপি’র নির্বাচন শেষ করতেও বেশি সময় দেওয়া যাবে না। রোজা শুরু ৬ জুন। রোজার মধ্যে ভোটগ্রহণ সম্ভব নয়। তার আগেই ভোট পর্ব শেষ করা যাবে বলে মনে করছে নির্বাচন কমিশন। কোনও দল নির্বাচন পিছনোর দাবি করলেও, তা মানা সম্ভব হবে না। ২০১১’র ইউ.পি নির্বাচনে সব প্রার্থীই ছিলেন নির্দল। পরোক্ষে দলীয় সমর্থন থাকলেও, তাঁদের দলীয় প্রার্থী হিসেব চিহ্নিত করা যেত না। এ বার সেটা হচ্ছে না। বহু দলীয় সংসদীয় নির্বাচনের মতো ইউপি’তেও হবে বহুমুখী লড়াই। প্রার্থী দেবে অনেক দল। সেই দলীয় প্রার্থীদের লড়াইয়ের ঝড়ে নির্দল প্রার্থীদের এ বার অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখাটাই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
নির্বাচনে মাটির টান, শহুরে গন্ধ নেই। পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েতের মতো ক্ষমতার বিভাজন ইউপি-তে অতটা প্রকট না হলেও, অনেকটাই। ধীরে ধীরে রাজনীতির শেকড় ছড়াচ্ছে এতাবৎ অনালোকিত এলাকাগুলোতেও। তাই, প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে মূল্য দিতে হবে সব দলকেই। তাঁদের ফাঁকি দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের এটাই উল্লেখযোগ্য ধাপ।
ইউপি’র চেয়ারম্যানের অধিকার থাকবে নিজের এলাকার ভালমন্দ বুঝে নেওয়ার। বরাদ্দ বাজেটের খরচের দায়ও তার। টাকার জন্য ঢাকার সচিবালয়ে দৌড়োদৌড়ির বিশেষ দরকার নেই।
আগে ইউপি’র সদস্যরা রাজনীতির বাইরে ছিলেন। তাঁদের সামনে কোনও রাজনীতির দিশা, হাতছানি ছিল না। শুধুমাত্র উন্নয়নের ওপর ভিত্তি করেই তাঁদের ভাবমূর্তি গড়ে উঠত। সবটাই ছিল ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাতে অনেক সময়েই নীতিগত শৃঙ্খলার অভাব দেখা দিত। এক ইউপি’র সঙ্গে অন্য ইউপি’র সমন্বয়ের সুযোগ থাকত না। বরং দূরত্ব বাড়ত। দলীয় অনুশাসন না থাকায় স্বৈরাচারী হয়ে ওঠারও সুযোগ ছিল। দুর্নীতি বাড়ত। দুর্নীতি প্রমাণ করাও সহজ ছিল না। চেয়ারম্যানরা ন্যায়-অন্যায় যা কিছু করতেন, সবটাই করতেন ব্যক্তিগত উদ্যোগে। অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের আখের গুছোনোর প্রবণতাও লক্ষ্য করা গিয়েছে। এলাকার প্রভাবশালীরা টাকা আর ক্ষমতার জোরে জয়ী হয়ে ছড়ি ঘোরাতেন।
ইউপি’র রাজনীতিকরণ নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য নির্বাচনী সংস্কার। প্রত্যন্ত অঞ্চলও আর বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকবে না। কোথায়, কতটা অগ্রগতি হচ্ছে, দলীয় ভিত্তিতে তার সরকারী হিসেব পাওয়া যাবে। সাফল্য-ব্যর্থতার দায় নিতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকেই।
রাজনৈতিক দলের সংখ্যাও কম নয়। অনেক। ছোট ছোট আকারে তারা ছিটিয়ে রয়েছে সারা দেশে। তার মধ্যে ঢুকে পড়েছিল জামাতও। আপাতত তারা বাতিল। আদালতের নির্দেশে ভোট লড়তে পারবে না। বিএনপি’র কাঁধে ভর দিয়ে নির্বাচনী ময়দানে নেমে পড়ার পরিকল্পনা ছিল। বিএনপি বিপদ বুঝে কাঁধ সরিয়ে নিয়েছে। তবু বিএনপি’কে ছুঁয়ে থাকার চেষ্টা প্রাণপণ। ইউপি’তে মূল লড়াই প্রধান দুই দল আওয়ামী লিগ আর বিএনপি’র।
নির্বাচন থেকে দীর্ঘ দিন দূরে ছিল বিএনপি। ২০১৪’র সংসদীয় নির্বাচনে তারা অংশ নেয়নি। দু’মাস আগে পৌর নির্বাচনে যোগ দিয়ে তারা নিজেদের অস্তিত্ব নতুন করে জানিয়েছে। এ বার ইউপি’তে তাদের পরীক্ষা দেওয়ার পালা। অনুশীলন শুরু হয়েছে, ভাল ফল করার চেষ্টায় তাদের খামতি নেই।
আওয়ামি লিগের দাপট বেশি। দেশ চালাচ্ছে তারা। ক্ষমতায় থাকার দরুন সংগঠনও বেড়েছে। তারা যতটা সম্ভব শেকড়ে পৌঁছনোর চেষ্টা করে চলেছে। সেটা বোঝাও যাচ্ছে, কারণ, আওয়ামি লিগের টিকিট পেতে লম্বা লাইন পড়েছে।
সব নির্বাচনেই ভোটারদের মধ্যে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা কাজ করে। তাঁরা সব সময়েই বিকল্প খোঁজেন। সেই ‘বিকল্প শক্তি’ বলতে বিএনপি ছাড়া কেউ নেই। মানুষের এই মানসিকতাই বিএনপি’র ভরসা। অগোছালো দলটাকে তারা গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। ইউপি নির্বাচনই বলে দেবে, কোন দলের শেকড় কতটা গভীরে পৌঁছেছে।