গরমে কাহিল ইউরোপ। ছবি: রয়টার্স।
কলকাতার গরম থেকে রেহাই পেতে দক্ষিণ আল্পসের কোলে থাকা কোনও গ্রামে ঘুরতে যেতে চান? একটু ভাবনাচিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ, গরমে সুইৎজ়ারল্যান্ডের জুরিখ কিংবা জেনেভার মতো শহর টেক্কা দিচ্ছে দিল্লি কিংবা কলকাতাকে। ইউরোপের অধিকাংশ দেশেই পরিস্থিতি প্রায় একই রকম। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, ইটালি, গ্রিস এবং সুইৎজ়ারল্যান্ডে। উত্তর গোলার্ধের দেশগুলিতে এই সময় তাপপ্রবাহের ঘটনা অস্বাভাবিক নয়। তবে তাপমাত্রার এই ঊর্ধ্বগতি ইউরোপে শেষ কবে দেখা গিয়েছে, তা মনে করতে পারছেন না অনেকেই। পরিস্থিতি এমনই যে, জুরিখ-নিবাসী এক বঙ্গসন্তান জানাচ্ছেন, এই পরিস্থিতি চললে আগামী দু’বছরের মধ্যে গোটা ইউরোপই ‘বসবাসের অযোগ্য’ হয়ে উঠবে।
পরিস্থিতি এমনই যে, সোমবার উইম্বলডনে গরমের জন্য ম্যাচ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন মহিলাদের সিঙ্গলসে দু’বারের উইম্বলডন ফাইনালিস্ট তিউনিসিয়ার ওন্স জাবেউর। সরে দাঁড়ানোর সময় তিনি বুলগেরিয়ার ভিক্টোরিয়া টোমোভার বিরুদ্ধে ৬-৭ (৫-৭), ০-২ পিছিয়ে ছিলেন। গরমে কাহিল হয়ে বেশ কয়েক বার বিরতি নিতে হয় তাঁকে। তোয়ালে চেপে কিছু ক্ষণ বসেও থাকেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর খেলা চালিয়ে যেতে পারেননি।
সুইৎজ়ারল্যান্ড: আল্পসের কোলে থাকা সুইৎজ়ারল্যান্ডের জুরিখ, জেনেভা শহরে রবিবার সকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩২ থেকে ৩৫ ডিগ্রির মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে। সপ্তাহান্তে পারদ আরও চড়তে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। অন্য দিকে, সোমবার সকালে কলকাতার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রয়েছে ৩০ ডিগ্রির আশপাশেই। নয়াদিল্লির সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ, গরমের নিরিখে কলকাতা কিংবা ভারতের রাজধানীকে টেক্কা দিচ্ছে সুইৎজ়ারল্যান্ডের একাধিক শহরও।
গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
স্পেন: শনিবার দক্ষিণ-পশ্চিম স্পেনের লা গ্রানাদো শহরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত ছয় দশকে কখনও এত গরম পড়েনি সে দেশে। এই পরিস্থিতিতে সে দেশের সরকারি আবহাওয়া বিজ্ঞান সংস্থা (এইএমইটি) জানিয়েছে, চলতি সপ্তাহে পরিস্থিতির বিশেষ হেরফের হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বরং, ভূমধ্যসাগর উপকূলীয় এলাকাগুলিতে আরও তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়ে সতর্ক করেছেন স্পেনের আবহবিজ্ঞানীরা। রোদে রাস্তায় না বেরোনোর পরামর্শ দিয়েছে সে দেশের সরকারও। তা ছাড়া বেশি করে জল খাওয়া, রাস্তায় বেরোলে চোখ-মুখ ঢেকে বেরোনোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
পর্তুগাল: মধ্য পর্তুগালের আলভেগা শহরে পারদ ছুঁয়েছে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগামী সপ্তাহ অবধি তাপপ্রবাহ চলার পূর্বাভাস রয়েছে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর দেশে। রাজধানী লিসবনেও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ফ্রান্স: তাপপ্রবাহে হাঁসফাঁস অবস্থা ফরাসিদেরও। ফ্রান্সের দক্ষিণ-পশ্চিমের শহরগুলিতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গিয়েছে। তার উপর সে দেশের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলে দাবানল তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্যেই বনাঞ্চল লাগোয়া এলাকা থেকে বহু মানুষকে সরিয়ে আনা হয়েছে। ফ্রান্সের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মার্সেইয়ে রবিবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গরম থেকে নাগরিকদের রেহাই দিতে মার্সেইয়ের স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশ— সরকারি মালিকানাধীন সুইমিং পুলের দরজা সকলের জন্য খুলে দিতে হবে।
গরমের মধ্যেই ভেনিসে বিয়ে ই-কমার্স সংস্থা ‘অ্যামাজ়ন’-এর কর্তা জেফ বেজ়োসের। ছবি: রয়টার্স।
ইটালি: পারদ চড়ার নিরিখে পিছিয়ে নেই ইটালিও। সে দেশের নেপল্স, পালেরমোর মতো শহরে রবিবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গ্রিসের সরকার উত্তর ইটালির একাধিক শহরে দুপুরে প্রকাশ্যে কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। তবে এই সময় ঘরের ভিতরে থেকে কাজ করা যাবে। ইটালির শ্রমিক সংগঠনগুলি দেশের অন্যান্য অংশেও এই পদক্ষেপ করার আর্জি জানিয়েছে। ভেনিসে ই-কমার্স সংস্থা ‘অ্যামাজ়ন’-এর কর্তা জেফ বেজ়োসের বিয়ে উপলক্ষে হাজির হয়েছিলেন দেশ-বিদেশের বহু গণ্যমান্য অতিথি। ব্রিটিশ সংবাজমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুসারে, গরমে কাহিল হয়ে তাঁরাও দ্রুত ভেনিস ছাড়ছেন।
গ্রিস: গ্রিসের একাংশেও তাপমাত্রা পৌঁছেছে ৪০ ডিগ্রি (সেলসিয়াস)-র ঘরে। গরমের দোসর হয়েছে দাবানল। দক্ষিণ এথেন্সে বৃহস্পতিবার যে দাবানল লেগেছিল, তা আরও ছড়িয়ে পড়েছে। সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসাবে ইতিমধ্যেই বহু মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনা হয়েছে। গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে ঢোকার রাস্তা আংশিক ভাবে বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
গরম থেকে বাঁচতে জলে ঝাঁপ। সুইৎজ়ারল্যান্ডে। ছবি: রয়টার্স।
ব্রিটেন: উইম্বলডন টেনিস টুর্নামেন্ট দেখতে ব্রিটেনে রয়েছেন বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের খ্যাতনামীরা। যুক্তরাজ্যে পরিস্থিতি ততটা খারাপ না-হলেও সেখানেও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা পৌঁছেছে ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। মঙ্গলবার তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধি পাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। ব্রিটেনের পর্যটনকেন্দ্রগুলিতে গরমের কারণে পর্যটকেরা কম যেতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কী কারণে গরমে কাহিল ইউরোপ:
আবহবিদদের বড় অংশই মনে করছেন, বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণেই গোটা বিশ্বের সঙ্গে এই পরিস্থিতির সাক্ষী হতে হচ্ছে ইউরোপবাসীকে। আগামী কয়েক বছরে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা। তা ছাড়া তাপমাত্রার এই খামখেয়ালিপনার জন্য স্থানীয় একটি কারণকেও দুষছেন আবহবিজ্ঞানীরা। তাঁরা জানিয়েছেন, পশ্চিম ইউরোপে একটি উচ্চচাপ বলয় অবস্থান করছে। ক্রমশ পূর্ব দিতে সরে যেতে যেতে উচ্চচাপ বলয়টি উত্তর আফ্রিকার গরম বায়ু স্থানীয় পরিমণ্ডলে টেনে আনছে। এই পরিস্থিতি থেকে এখনই নিস্তার নেই বলে জানানো হয়েছে।
গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা ব্রিটেনবাসীরও। ছবি: রয়টার্স।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস ও বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন বলছে, এই রকম ভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মহাদেশটির লক্ষ লক্ষ মানুষ ঝুঁকির মুখে পড়ছেন।
প্রতিবেদনে প্রকাশ, ইউরোপে চরম আবহাওয়ার ঘটনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন, গত অক্টোবর ও নভেম্বরে স্পেনের ভালেনসিয়ায় বন্যায় ২২০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তার ঠিক মাসখানেক আগে বোরিস ঝড়ে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের আটটি দেশের বিভিন্ন শহরে বন্যা হয়। এতে চার লক্ষেরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন৷ প্রতিবেদনে এ-ও বলা হয়েছে, পূর্ব ইউরোপে গ্রীষ্মকালে তীব্র তাপপ্রবাহ যেমন দেখা যাচ্ছে, তেমন দক্ষিণ ইউরোপে শীতকালে দীর্ঘস্থায়ী খরার প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে, স্বস্তিতে নেই ইউরোপ।