টেরিজার আলোয় বিশ্বপথে কলকাতা

কলকাতার যিশুদের কোলে টেনে নিয়েছিলেন তিনি। আজ ‘কলকাতার সন্ত’ হলেন মাদার টেরিজা। তবু পোপ ফ্রান্সিস কী বললেন? ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারে মাদারের ‘সন্তায়ন’ অনুষ্ঠানের শেষ লগ্নে নিজের বক্তৃতায় তিনি বললেন, ‘‘আমরা তো এখনও ওঁকে ‘মা’ বলেই ডাকতে পারি। হয়তো অনেকের ওঁকে ‘সন্ত’ বলতে অসুবিধে হবে।’’

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

ভ্যাটিকান সিটি শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৪:৫৯
Share:

সামনের সারিতে নিয়ে যাচ্ছেন সিস্টার প্রেমা। — নিজস্ব চিত্র

কলকাতার যিশুদের কোলে টেনে নিয়েছিলেন তিনি। আজ ‘কলকাতার সন্ত’ হলেন মাদার টেরিজা।

Advertisement

তবু পোপ ফ্রান্সিস কী বললেন? ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারে মাদারের ‘সন্তায়ন’ অনুষ্ঠানের শেষ লগ্নে নিজের বক্তৃতায় তিনি বললেন, ‘‘আমরা তো এখনও ওঁকে ‘মা’ বলেই ডাকতে পারি। হয়তো অনেকের ওঁকে ‘সন্ত’ বলতে অসুবিধে হবে। উনি আমাদের এতই আপন যে, আমরা তাঁকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ‘মা’ বলেই ডেকে যাব।’’

এত ক্ষণ কেমন ঘোর লাগছিল। লক্ষাধিক মানুষের একটা ভিড়। যার একটা অংশে সাদার ছোপ। যেখানে যাজকদের আর মাদারের ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’-র সন্ন্যাসিনীদের আসন। আর বাকিটুকু? উঁচু থেকে এক বার ভিড়টাকে দেখে মনে হচ্ছিল, প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের পাথর বাঁধানো চত্বরে যেন মিশে গিয়েছে রামধনুর সব রং। সেই ভিড়ের ফাঁকে ফাঁকেই মাথা উঁচিয়ে ভারতের জাতীয় পতাকা। হাতে হাতে পোস্টার, মাদারের ছবি আঁকা টি-শার্ট পরা অনেকগুলো চেহারা।

Advertisement

সমবেত মন্ত্রোচ্চারণে সেই জনসমুদ্রে এক-এক বার জেগে উঠছে সুরের ঢেউ। আবার পরক্ষণেই অপার নৈঃশব্দ। আকাশ ঝলসানো চ়ড়া রোদ। সেই রোদ উপেক্ষা করেই আড়াই ঘণ্টা ঠায় বসে রইল ভিড়টা। যার মধ্যে রইলেন বিভিন্ন দেশ ও রাজ্যের সরকারের ১৩ জন প্রধান। রইলেন স্পেনের রানি সোফিয়া।

কী ভাবে আঁকা হয় এই ছবি? শ্রদ্ধা-আবেগ-ভালবাসা— সব কিছু এমন মিলেমিশে যায় কোন মন্ত্রে? এই সব উত্তরই যেন এক সুতোয় গেঁথে নিলেন পোপ— ‘মায়ের’ টানে! সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার সামনে টাঙানো ছবি থেকে যিনি হাসিমুখে তাকিয়ে রয়েছেন। আজ থেকে তিনি ‘সন্ত’। তাই মাথার পেছনে একটি জ্যোতির্বলয়।

উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে একটি সুসজ্জিত মঞ্চ। সামনে সারি বাঁধা দর্শকাসন। সকাল ১০টা থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল প্রার্থনা। থেকে থেকেই ঘণ্টাধ্বনি। ভিড়ের কথা বলছিলাম। সেই ভিড় একটু বাড়তে দেখা গেল, ‘একটা মিনি ভারত’, তার মধ্যে আবার ‘এক টুকরো কলকাতা’ও তৈরি হয়ে গিয়েছে কখন। বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের নেতৃত্বে ভারত সরকারের প্রতিনিধিদল হাজির। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও পৌঁছে গিয়েছেন। সঙ্গে তাঁর প্রতিনিধিদল। মমতার পাশেই বসলেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল। একটু পরেই মাদারকে নিয়ে বাঁধা গান যিনি গাইলেন, তিনিও কলকাতার। ঊষা উত্থুপ।

এক-এক সময় মনে হবেই, নিখুঁত কোনও ‘ইভেন্ট’ যেন। সুশৃঙ্খল ছকে বাঁধা, নিক্তি-মাপা প্রতিটা ধাপ। ছবির মতো শোভাযাত্রা-সহ এলেন পোপ ফ্রান্সিস। যাজকদের সমবেত মন্ত্রোচ্চারণে শুরু হল মূল অনুষ্ঠান। নিয়মমাফিক পোপের কাছে মাদার টেরিজাকে ‘সেন্ট টেরিজা অব ক্যালকাটা’ হিসেবে গণ্য করার আর্জি পেশ করলেন ‘প্রিফেক্ট’ কার্ডিনাল অ্যাঞ্জেলো আমাতো। মাদারের সংক্ষিপ্ত জীবনী পাঠ করলেন তিনি। ভাষাটা লাতিন। তবু ফিরে ফিরে আসছিল ‘কালকুতা’। ‘ক্যালকাটা’ থেকে বহুদিন আগেই ‘কলকাতা’য় পৌঁছে গিয়েছি আমরা। তবু এখানে এসে মাদারের সৌজন্যেই শুনলাম ‘মাদার টেরিজা অব ক্যালকাটা’।

জীবনী পাঠের পর আবার প্রার্থনা। তার পরেই সেই বহুপ্রতীক্ষিত মুহূর্ত। ‘দ্য ফরমুলা অব ক্যাননাইজেশন’ পাঠ করলেন পোপ। যার মর্মার্থ— আজ থেকে ‘সন্ত’ হলেন কলকাতার মাদার। সমবেত কণ্ঠে ধ্বনিত হল ‘আমেন’। এক মুহূর্ত সব চুপ। তার পরেই সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারে হাজার পায়রা ওড়ার শব্দ— হাততালির।

মঞ্চে এ বার আনা হল ‘আধ্যাত্মিক রেলিক’। মাদারের পবিত্র স্মারক। নীল-সাদা ঘোমটার আদলেই একটি ফলক। স্মারকের সামনে বাতি জ্বালিয়ে দিলেন দুই সন্ন্যাসিনী। কলকাতা থেকে আর্চবিশপের ব্যবস্থাপনায় আনা হয়েছে মাদারের এক টুকরো চুল আর দাঁত। ভ্যাটিকান সিটিতে এসে এ বার থেকে ‘সন্ত’ টেরিজার নশ্বর শরীরের এই সংরক্ষিত স্মৃতিচিহ্ন দেখতে পাবেন তীর্থযাত্রী-পর্যটকেরা। কত অসুস্থ মানুষ হুইল চেয়ার আর অক্সিজেন সিলিন্ডার-স্যালাইনের বোতল নিয়ে এসেছিলেন আজ। ক্যাথলিক বিশ্বাস, সন্তায়নের গণপ্রার্থনায় যোগ দিলে জীবনের সব পাপ লাঘব হয়। রোগমুক্তি হয়। কে জানে কেন, মনে পড়ল কুম্ভমেলা।

দীর্ঘ প্রার্থনাসঙ্গীতের মাঝে মাঝেই চলছিল নানা ভাষায় পাঠ। হঠাৎ ছড়িয়ে গেল বাংলা ভাষা। মঞ্চে তখন সিস্টার অমলা বলছেন, ‘‘তুমি তাদের পরিচালিত করো প্রভু, যেন তারা বেছে নিতে পারে সেই সব কিছু, যা সমস্ত মানবজাতির জন্য যথার্থই মঙ্গলময়...।’’

এই বাণীর সুরেই পোপ বাঁধলেন তাঁর বক্তৃতাকে। বললেন, ‘‘জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই অপার দয়া ও করুণা বিলিয়ে গিয়েছেন মাদার। যে শিশু এখনও ভূমিষ্ঠ হয়নি, যে শিশুকে পথের ধারে ফেলে রেখে যাওয়া হয়েছে— সকলের জীবন বাঁচানোর জন্যই তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাঁর কাছে করুণা হল ‘নুন’-এর মতো একটি উপাদান, যা তাঁর কর্মকাণ্ডে অন্য মাত্রা যোগ করেছিল।’’

অনুষ্ঠান শেষে প্রসাদ বিতরণ। শুরু হয়েছিল সকাল ১০টায়। চলল আড়াই ঘণ্টা। পোপ তাঁর গাড়িতে ঘুরে ঘুরে অভিবাদন জানালেন ভক্তদের।

মুগ্ধতা আর আবেগে অবশ্য জড়িয়ে রইল বিতর্কও। মাদারের সন্তায়ন নিয়ে সমালোচনা করতে ছাড়েনি সংবাদমাধ্যমের একটি ছোট অংশ। তারা প্রশ্ন তুলেছে, কেন মাদারের মৃত্যুর এত অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁকে সন্ত ঘোষণা করা হবে? তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে কেউ কেউ। কিন্তু এটাও ভ্যাটিকান সিটির গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। যেখানে সংবাদমাধ্যম এই সার্বভৌম পোপের দেশেও ভিন্ন মত পোষণ করতে পারে।

সন্তায়ন বা ‘ক্যাননাইজেশন’ বহু প্রাচীন এক খ্রিস্টধর্মীয় পরম্পরা। এখনও পর্যন্ত সন্ত হয়েছেন ৮১০ জন। অতীতে সন্ত ঘোষণার ঘটনাও ছিল বিরল। এক-এক জনের সন্ত হতে অনেক সময় এক শতাব্দী কেটে যেত। কিন্তু সমাজ বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সন্ত হওয়ার প্রক্রিয়াতেও এসেছে নানা সংস্কার। মাদার যেমন সন্ত হলেন মৃত্যুর মাত্র ২০ বছরের মাথায়। আর্জেন্তিনার মানুষ, আজকের আধুনিক পোপ ফ্রান্সিস অনেক প্রাচীন প্রথাই ভাঙছেন। আগে প্রথা ছিল, কোনও ব্যক্তির মৃত্যুর অন্তত পাঁচ বছর পর সন্ত ঘোষণার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। পোপ ফ্রান্সিস বলছেন, পাঁচ বছরও অপেক্ষা করা বাধ্যতামূলক নয়।

জীবদ্দশায় সমালোচনা-সন্দেহ কিছু কম শুনতে হয়নি মাদারকে। তবু আজকের সভায় নিঃসন্দেহে সৃষ্টি হল এক অনির্বচনীয় মুহূর্ত। ভ্যাটিকান সিটি আজ যেন কলকাতা তো বটেই, গোটা ভারতকেই দিল এক বিরল সম্মান। উজ্জ্বল হয়ে রইলেন আর্তের সেবায় সর্বত্যাগী ‘সন্ত’ মাদার টেরিজা। বিশ্ববাসীকে যাঁর হাসি হৃদয়ের গভীরে বহন করার আহ্বান আজ জানিয়ে গেলেন পোপ ফ্রান্সিস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন