বিশ্বকাপ আসেনি, তবু ‘বিজয়ী’ বরণে তৈরি হচ্ছে নিউজ়িল্যান্ড

শান্তিপ্রিয় এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ— কিউইদের ক্ষেত্রে এই কথাগুলো বরাবরই খাটে। এ দেশের পুলিশের কাছে বেশির ভাগ সময়েই আগ্নেয়াস্ত্র থাকে না।

Advertisement

শুভময় গঙ্গোপাধ্যায়

অকল্যান্ড শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৯ ০৩:২৩
Share:

নিউজ়িল্যান্ডের ক্রিকেট টিম। ইনসেটে লেখক।

না, ওঁরা বিশ্বকাপ নিয়ে ফিরছেন না। তবু দেশের মাটিতে বিজয়ীর সংবর্ধনাই পাবেন অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনের ‘মেন ইন ব্ল্যাক ক্যাপস’। নিউজ়িল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডের্ন নিজে উদ্যোগ নিয়েছেন যে! রবিবার বিশ্বকাপের ফাইনাল গড়িয়েছিল সুপার-ওভার পর্যন্ত। কিন্তু সেটাও টাই হয়ে যাওয়ায় অগত্যা ‘বাউন্ডারি রুলে’ কাপ ছিনিয়ে নেয় ইংল্যান্ড। এর পরেই এক রেডিয়ো সাক্ষাৎকারে জেসিন্ডা বললেন, ‘‘ফাইনালের এই ফলাফলে বেশির ভাগ দেশবাসীর মতো আমিও মর্মাহত।’’ আর তার পরেই জুড়ে দিলেন— ‘‘কিন্তু ফল যা-ই হোক আমাদের ছেলেরা যে অবিশ্বাস্য ক্রিকেট খেলেছে, তা গর্ব করার মতোই। আমি গর্বিত।’’

Advertisement

পাঠকেরা হয়তো জানেন, এ দেশে খেলাধুলোর মধ্যে সব চেয়ে জনপ্রিয় রাগবি। তুলনায় ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা অনেকটাই কম। তবু আজ অফিসে বেশ কয়েকজন কিউয়ি সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, অনেকেই রাত জেগেছেন। তবে তাঁদের চোখেমুখে ক্লান্তির চেয়ে বেশি স্পষ্ট হতাশা। দুঃখটা তীরে এসে তরী ডোবার। নেহাত বাউন্ডারির সংখ্যার বিচারে নিজেদের প্রিয় দলকে হারতে দেখার।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, আক্রোশ দেখছি না। এমনকি খেলার নিয়ম-কানুন নিয়ে দোষারোপ করতে দেখিনি এ দেশের সংবাদমাধ্যমকেও। কেন বাউন্ডারির সংখ্যা বিচার্য হবে, বা ওভারথ্রোতে এক আর চারে পাঁচ রান না-হয়ে দুই আর চারে ছয় কেন হল— তা নিয়েও আইসিসি কিংবা আম্পায়ারদের মুণ্ডপাত করতে দেখলাম না কাউকে। কুখ্যাত সেই ওভারথ্রোটা আবার যাঁর ব্যাটে লেগে ছিটকে গেল, সেই ম্যান অব দ্য ম্যাচ বেন স্টোক্সের জন্ম ক্রাইস্টচার্চে। বারো বছর বয়স পর্যন্ত থাকতেন নিউজ়িল্যান্ডেই। এঁকে দেশদ্রোহীর তকমা দেওয়া যায় কি না— এমনটাও কেউ ভাবছেন না। সুপার ওভারে রস টেলরকে না-নামিয়ে কেন অফ-ফর্মের গাপ্টিলকে নামানো হল— এই নিয়েও অধিনায়ক বা কোচকে কেউ তুলোধোনা করছেন না।

Advertisement

ভাবতে বসলাম, কী ভাবে এতটা নিস্পৃহ থাকা সম্ভব! এমন কঠিন লড়াইয়ের পরেও এঁরা এত সহজে হার মেনে নেন কী করে? ক্রিকেট নিয়ে পাগলামো কিছুটা কম বলে কি! হতে পারে, দলটায় তেমন তারকা কেউ নেই বলে এমন হাবভাব দেশের। অথবা এটাই এ দেশের বৈশিষ্ট্য। ‘কর্মেই তোমার অধিকার, ফলে নয়’— প্রখর ক্রিকেট

বুদ্ধিতে এতটা এগিয়ে এসে হেরে যাওয়ার পরেও উইলিয়ামসনদের এমন অভিব্যক্তি এক কথায় অতুলনীয়।

খেলা শেষে ক্যাপ্টেনকে দেখলাম মনে কষ্ট রেখেও হেসে-হেসে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। স্বীকার করলেন, ‘বাউন্ডারি রুলে’ এই পরাজয়

মেনে নিতে তাঁর কষ্ট হচ্ছে। তবু বললেন, শুধু এই ম্যাচের জেরে নিয়ম পাল্টানো ঠিক হবে না। উইলিয়ামসন ঘরে কাপ আনতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু জনগণের মন অবশ্যই জয় করেছেন।

গোটা বিশ্বকাপ জুড়ে দেখেছি, প্রবল চাপের মধ্যেও বরফের মতো ঠান্ডা মাথা উইলিয়ামসনের। সেমিফাইনালে ভারতের বিরুদ্ধে মাঠে নামার আগেও দেখেছি, অবলীলায় প্রশংসা করছেন ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহালির। এই কোহালির কাছেই অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ হেরেছিলেন। তবু উত্তাপহীন উইলিয়ামসন। আর এটা যেন নিউজ়িল্যান্ডের জাতীয় চরিত্রেরই নিদর্শন।

শান্তিপ্রিয় এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ— কিউইদের ক্ষেত্রে এই কথাগুলো বরাবরই খাটে। এ দেশের পুলিশের কাছে বেশির ভাগ সময়েই আগ্নেয়াস্ত্র থাকে না। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এখানকার সরকারি দফতরেও প্রত্যেককে যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে কথা বলা হয়। এটাই আইন, এটাই দস্তুর। ফলে এ দেশের পুলিশ যখন কোনও গৃহহীন গরিবের সঙ্গে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কথা বলে, মনে হয় না সেই নাগরিক পুলিশকে ভয় পাচ্ছেন।

এক দিন ট্রেনে অফিস যাওয়ার পথে কানে এল— এক সহযাত্রী ট্রেনের কন্ডাক্টরকে গল্প করে বলছেন, সদ্যই তিনি জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। কন্ডাক্টরকে দেখি, মন দিয়ে সব শুনলেন। আর ওই জেলখাটা যাত্রী প্ল্যাটফর্মে নেমে যাওয়ার আগে বলছেন— ‘‘ভাল থাকবেন। সাবধানে যাবেন।’’ সে দিনই বুঝেছিলাম, এ দেশে জেলফেরতকেও মানুষের মর্যাদা দেওয়া হয়। এমন অনেক ব্যাপারেই বোধ হয় নিউজ়িল্যান্ড তাই ব্যতিক্রমী। তাই উইলিয়ামসনের মতো ব্যক্তিত্বের অধিনায়ক এমন দেশ থেকে উঠে আসা আশ্চর্যের কিছু নয়।

কাপ-ফাইনালে হারলেও পঞ্চাশ লক্ষেরও কম জনসংখ্যার ছোট্ট দেশ নিউজ়িল্যান্ড ফের দুনিয়ার দরবারে নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। গত মার্চ মাসে ক্রাইস্টচার্চে জঙ্গি হামলার পরে বলিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডের্ন। আজ ব্ল্যাক-ক্যাপস টিমের অধিনায়ক হিসেবে ক্রিকেট দুনিয়ার মন জয় করলেন কেন উইলিয়ামসন। এঁদের তো বিজয়ীর সংবর্ধনাই প্রাপ্য!

(লেখক অকল্যান্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষক)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন