বেয়নেট বনাম ফুল: ৫০ বছর আগের সেই ছবি হাতে এখন জান রোজ ক্যাস্মির।
তিনি কি শুধুই ছবি!
এ কথাটা কখনও তাঁকেও তাড়া করেছে বটে। তবে সেই ছবির জোরটা বুঝতে ভুল করেননি জান রোজ ক্যাস্মির। তাই অর্ধশতক আগের ছবির গল্পটা গুছিয়ে লিখে ফেলেছেন। আর জানের সেই ছবির সঙ্গেই এ বার জড়িয়ে পড়ছে কলকাতা।
এটুকু বললে হয়তো কিছুই বোঝা যাবে না। কিন্তু যদি বলা হয় ভিয়েতনাম যুদ্ধের ‘ফ্লাওয়ার চাইল্ড’! খাস পেন্টাগনে উদ্ধত বেয়নেটের সামনে ক্রিসেনথিমাম হাতে দাঁড়িয়ে সপ্তদশী। বেয়নেটধারী নতমুখ মার্কিন সেনার সামনে ফুল হাতে তরুণীর চোখজোড়াই যা বলার বলে চলেছে। ১৯৬৭-র এক অক্টোবর বিকেলে ফরাসি আলোকচিত্রী মার্ক রিবুর ছবিটি এখনও দুনিয়া জুড়ে যুদ্ধ বিরোধিতার অন্যতম মুখ। সদ্যপ্রয়াত রিবু পরে বলেছিলেন, ‘‘মার্কিন সেনাই মেয়েটার নিষ্পাপ চোখে চোখ রাখতে ভয় পাচ্ছিল।’’
ছবির পিছনের মুখ জান এখন এ শহরের এক প্রৌঢ় সুব্রত ঘোষকে তাঁর ‘ব্রাদার ইন পিস’ করেছেন। আর ফেসবুক মেসেঞ্জারে জানের প্রথম বই নিয়ে গল্পের ফাঁকে সুব্রতই তার প্রচ্ছদ করে দিয়েছেন। বইয়ের নাম, ফ্লাওয়ার চাইল্ড: দ্য স্টোরি বিহাইন্ড দ্য ফটো। শনিবার তখন বেলা সাড়ে ১১টা (ওয়াশিংটন ডিসি-তে শুক্রবার রাত একটা)।
ফোনে আনন্দবাজারকে জান বলছিলেন, ‘‘আগেও কেউ কেউ চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সুব্রতর নকশাটাই নিখুঁত হয়েছে।’’
ছবিটির নাম, ‘আলটিমেট কনফ্রন্টেশন’ বা চরম সংঘাত। অনেকেই বলেন, ২১ অক্টোবর যুদ্ধ-বিরোধীদের মিছিলের এই ছবিই আরও প্রতিবাদ উস্কে ভিয়েতনাম যুদ্ধের অভিমুখ পাল্টে দিয়েছিল। এখন ৬৭ বছরেও পাল্টে দেওয়ার স্বপ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন ‘ফ্লাওয়ার চাইল্ড’! পেশায় মাসাজ থেরাপিস্ট, দক্ষিণ ক্যারোলাইনার বাসিন্দা জান প্রতিবাদের টানেই সদ্য ওয়াশিংটনে গিয়েছেন। ‘‘এখনও এত জাতিবিদ্বেষ, অভিবাসীদের প্রতি ঘেন্না! প্রতিবাদই একমাত্র রাস্তা।’’ শনিবার ওয়াশিংটনের ট্রাম্প-বিরোধী ইমপিচমেন্ট র্যালিতেও তিনি পা মিলিয়েছেন।
ভিয়েতনাম যুদ্ধে জানের প্রতিবাদের সময়ে সুব্রত দশ বছরের বালক। ‘তোমার নাম, আমার নাম ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম’ স্লোগানে মুখর তাঁর কৈশোরের কলকাতা। ‘‘বিমান হানার সময়ে দিশেহারা ন’বছরের এক নগ্ন শিশু আর ফ্লাওয়ার চাইল্ড— ভিয়েতনাম যুদ্ধের দু’টো ছবিই মনে গেঁথে গিয়েছিল,’’ বলছিলেন পেশায় স্থপতি ৬০ বছরের সুব্রত। ভিয়েতনামে বেড়াতে গিয়ে সেই ন’বছরের মেয়েটির বাড়ি তিনি দেখে এসেছেন। আর দু’বছর আগে জানকে খুঁজে পেলেন ফেসবুকে। তাঁর তরুণ সহকর্মীদের তখন প্যারিসে বিশ্বশান্তি-বিষয়ক একটি ডিজাইন প্রতিযোগিতায় সামিল করতে চাইছেন সুব্রত। জানকে ‘মেসেজ’ করে তিনি জানান, কী ভাবে ফুল হাতে প্রতিবাদের শিল্পিত ভঙ্গি আজও তাঁদের প্রেরণা। জবাব আসে মাস চারেক বাদে। সেই থেকে বন্ধুত্ব।
তাঁর নিজের বিশ্ববিখ্যাত ছবির কথা জান অবশ্য জানতেনই না দীর্ঘদিন। পরে বোঝেন প্রতিবাদের শক্তি। ‘‘পারলে ৯০ বছরেও পরমাণু চুল্লির সামনে প্রতিবাদ করব,’’ বলে ওঠেন ফ্লাওয়ার গার্ল। আগে কবিতা লিখতেন। ‘‘কিন্তু লেখালিখি করার ধৈর্য ছিল না,’’ সাত-আট হাজার শব্দের বইটা লিখে বলছেন জান!
‘‘বেয়নেটধারী সেনাদের দেখে মনে হয়, ওরাও আমারই মতো ছিল! বেচারিরা নির্দেশের চাকর। কম বয়সের আবেগ আর ভালবাসার টানেই ভয়ডর উবে গিয়েছিল!’’
তাঁর বইয়ে সেই ভালবাসার কথাই ছড়িয়ে দিতে চান জান। যেখানে মিশে আছে কলকাতার বন্ধুতার স্মারক।