Puja Story

তবুও তো আছে কিছু এই বিভুঁইয়ে

চার দিন মাকে ঘরে রাখার সাধ্য নেই আমাদের, সপ্তাহান্তের পুজো যে, কোথাও দু’দিন, কোথাও তিন দিন, যে যতটুকু পারে তার সবটুকু দিয়েই পুজোর আনন্দ চেটেপুটে নিতে কমতি রাখে না কিছুর। গোটা উত্তর আমেরিকায় কত পুজো যে হয় তার ইয়ত্তা নেই, তবে নিউইয়র্ক-নিউ জার্সির পুজো বোধহয় সংখ্যার দিক থেকে টেক্কা দিয়ে যায় সবাইকে।

Advertisement

ঋতুপর্ণা দাশদত্ত

নিউ জার্সি শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ১৮:০৬
Share:

নিউ জার্সির দুর্গা পুজো।

আমাদের ম্যাডক্স স্কোয়ার নেই, চোখ ধাঁধানো মণ্ডপ নেই পাড়ায় পাড়ায়, আলোর বাহার নেই, কুমোরটুলি, মহম্মদ আলি পার্ক, মুদিয়ালি হয়ে একডালিয়া এভারগ্রিন অবধি রাতভর হাঁটা নেই, ভাল লাগার আরও কত কিছুই যে নেই! তবুও তো আছে কিছু...একবুক নস্ট্যালজিয়া আছে, ফেলে আসা বয়ঃসন্ধিকে ছুঁয়ে দেখার আকুলতা আছে, নিজের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ আছে, বুকভরা আন্তরিকতা আছে। আছে, আরও অনেক কিছুই আছে।

Advertisement

চার দিন মাকে ঘরে রাখার সাধ্য নেই আমাদের, সপ্তাহান্তের পুজো যে, কোথাও দু’দিন, কোথাও তিন দিন, যে যতটুকু পারে তার সবটুকু দিয়েই পুজোর আনন্দ চেটেপুটে নিতে কমতি রাখে না কিছুর। গোটা উত্তর আমেরিকায় কত পুজো যে হয় তার ইয়ত্তা নেই, তবে নিউইয়র্ক-নিউ জার্সির পুজো বোধহয় সংখ্যার দিক থেকে টেক্কা দিয়ে যায় সবাইকে।

Advertisement

আরও পড়ুন: অদ্ভুত এই গোলাপি হ্রদগুলি বিশ্বের কোন দেশে আছে জানেন?

আমি নিজে জড়িয়ে আছি কল্লোল-এর পুজোর সঙ্গে, খানিকটা পারিবারিক সূত্রেই বলা যায়। আর কল্লোল হল উত্তর আমেরিকার চার-পাঁচটা বড় পুজোর একটি, তিন দিনের পুজোয় চার-পাঁচ হাজার মানুষের ভিড় হয় এখানে। কল্লোলের পুজো তো আমার ঘরের পুজো, তা ছাড়াও নিউ জার্সির অন্যান্য উল্লেখযোগ্য পুজো যেমন আনন্দ মন্দির, ভারত সেবাশ্রম, উৎসব, চেরি হিল, আটলান্টিক সিটি, ইন্ডিয়ান কালচারাল সেন্টার, গার্ডেন স্টেট পুজো কমিটি ইত্যাদি ইত্যাদি। এক নিউ জার্সিতেই এখন পুজো হয় খান বারো।

প্রস্তুতির গল্পটা অবশ্য কমবেশি একই রকম। কলকাতার বারোয়ারি পুজোয় যেমন সিংহভাগ জুড়ে থাকে মণ্ডপের পরিকল্পনা, মণ্ডপ নারকোলের খোল দিয়ে হবে না কি চায়ের ভাঁড়, বরাত কাকে দেওয়া হবে, সুশান্ত পাল না কি সনাতন দিন্দা— এখানে সে বালাই নেই, কল্লোলের পুজো যেমন হয় ইউক্রেনিয়ান চার্চে, সর্বধর্ম সমাহারের বিজ্ঞাপন একেবারে, কোনও পুজো হয় স্কুল হল-এ বা কোনওটা কোনও পারফর্মিং আর্ট সেন্টারে। ভারত সেবাশ্রম বা আনন্দ মন্দিরের পুজো অবশ্য হয় তাদেরই নিজস্ব মন্দির চত্বরে, একেবারে কলকাতার পুজোর সঙ্গে একই দিনে।

আরও পড়ুন: মাংস খাচ্ছেন গণেশ! অসি-বিজ্ঞাপনে কড়া নিন্দা নয়াদিল্লির

এখানে ব্যস্ততার পুরোভাগে থাকে জলসা, মূলত কলকাতার শিল্পীদের নির্বাচন ও উড়িয়ে আনার প্রস্তুতি। রূপঙ্কর না কি রাঘব, না না, ওরা তো বহু বার গেয়ে গেছে। অনুপম? যাঃ, অমুক পুজো অলরেডি বুক করে দিয়েছে তো! সিসি কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিল! ইমনের তো বাজার গরম, অ্যাওয়ার্ডটা টাটকা থাকতে থাকতেই এনে ফেলা যাক, সারেগামা-র জীমুত কিন্তু হেব্বি গাইছে, আর এখনও অত পায়াভারি হয়নি, ডাকবে না কি! নানা মুনির নানা মত-মতান্তর-মনান্তর-বাকবিতন্ডা চলতেই থাকে বছরভর। কোন পুজো কাকে আনছে তার উপরেই তো নির্ভর করে রেজিস্ট্রেশন। আর লোকাল প্রোগ্রাম সিলেকশন, বোঝাই যায়, কলকাতা হোক বা ক্যালিফোর্নিয়া, চাঁদে গেলেও বাঙালি বাঙালিই। অমুকে কেন নৃত্যনাট্য করাচ্ছে, তমুককে কেন সোলো দেওয়া হল, ও তো গত বছরেই বাচ্চাদের প্রোগ্রাম করিয়েছিল, আবার এবছর! নিশ্চয়ই কালচারাল সেক্রেটারির সঙ্গে আঁতাত আছে। পাশাপাশি, শ্রীমতী ক শ্রীমতী খ-এর সঙ্গে এক স্টেজে নাচ করবে না, গ আবার ঘ-এর সঙ্গে এক মঞ্চে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ডায়লগ বলবে না, বোর্ড অব ট্রাস্টির মেম্বার কেন অমুক আর্টিস্টকে কনফার্ম করে ফেলল কালচারাল কমিটির অজান্তে— প্রায় মানহানির মামলা ঠুকে দেওয়ার মতোই ঘোরতর ব্যাপার! এই সব হাস্যকর চাপানউতোর চলতেই থাকবে বছর বছর, ওই যে বললাম, আমেরিকা কেন, চাঁদে গেলেও বাঙালি এই বাঙালিয়ানা ছাড়তে পারবে না, গান হবে নাচ হবে জলসা হবে, পুজো হবে, আর বাঙালি একটু খুনসুটি করবে না, একটু ল্যাজা মুড়ো ধরে টানবে না, একটু পলিটিক্স করবে না, তা কি হয়! আর সত্যি বলতে কি ঝোলে ঝালে অম্বলে এই ফোড়নটুকু না থাকলেও যেন উৎসবের ফ্লেভারটা আসে না।

উৎসব ঘিরে চলছে পেটপুজো।

পুজোর ক’টা দিন মহিলাদের পোয়াবারো এখানেও। তিন-চার দিন হেঁসেল বন্ধ। কোনও দিন খিচুড়ি-লাবড়া-বেগুনভাজা তো কোনও দিন পোলাও-কচি পাঁঠার ঝোল, সকাল রাত্তি হোল ফ্যামিলি নিয়ে পুজো-ভেন্যুতে হাজির হলেই হল। শাড়ি গয়না ঝলমলিয়ে পটের বিবি সেজে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ তো এখানে বড় বেশি মেলে না। আর পেটপুজোর ব্যাপারে বাঙালির ঘনীভূত আবেগের কথা যত কম বলা যায় ততই ভাল। শুনেছি এক বার নাকি কল্লোলের পুজোয় পাঁঠার মাংস কম পড়েছিল বলে পুজো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। মধ্যরাতে দোকান খুলিয়ে ৮০০ পাউন্ড পাঁঠা কিনে তবে প্রাণে বেঁচেছিলেন উদ্যোক্তারা! গুজব কি না জানি না।

তবে কষ্ট হয় এ দেশে জন্মানো বাঙালি ছেলেমেয়েগুলোর জন্য। সপ্তমীতে চোখাচোখি, একটু প্রশ্রয় পেলে অষ্টমীতে অঞ্জলির সময় হাত ছুঁয়ে ফেলা, না বলা কথায় তোমাকে চাই-এর শিহরন এরা জানলই না। অবশ্য কলকাতার কৈশোরই বা এখন তা জানে কি! জানি না। তবু বাঁধনছাড়া ধুন্ধুমার স্বাধীনতা পুজোর কটা দিন ছাড়া কবেই বা মেলে। মা তো ব্যস্ত শাড়ি ঝলমলিয়ে সেলফি তুলতে বা বাবাকে দিয়ে ছবি তোলাতে!

খুব ভাল লাগে কচিকাঁচাদের দেখতে, আমাদের বাংলা যখন ছানাপোনাদের বাংলা ভোলাতে উঠেপড়ে লেগেছে তখন এখানে যখন কচি কচি স্বরে ভাঙা উচ্চারণে বাংলা গান বাংলা ছড়া ভেসে আসে মঞ্চ থেকে, এই সাদা চামড়ার দেশে এইটুকু বাংলা বাঁচিয়ে রাখতে বাবা-মাকে কত কষ্টই না করতে হয়, বুঝতে পারি আর ভরসা পাই নিজের মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে, এইটুকু বাংলা তা হলে ওর মধ্যে আমিও বাঁচিয়ে রাখতে পারব।

তাই বলছিলাম, আছে অনেক কিছুই, রাত থাকতে উঠে আনন্দমন্দির বা ভারত সেবাশ্রমে লাইভ মহালয়া শোনা আছে, নতুন পাটভাঙা শাড়ির গন্ধ আছে, শারদীয় পত্রিকা আছে, রাতভর মণ্ডপ ঘিরে গোলটেবিল আড্ডা আছে, কব্জি ডুবিয়ে কচি পাঁঠার ঝোল আছে, ভোরে উঠে পুজোর ফল কাটা আছে, মণ্ডপ হপিং আছে, কলকাতা থেকে উড়িয়ে আনা ঢাকির বাদ্যি আছে, ধুনুচি নাচ, সিঁদুর খেলা আছে আবার পুজো শেষের মন খারাপও আছে বড় বেশি রকম।

দশমী, মানে এখানে কোনও এক রোববার সকাল থেকেই বিষন্নতা, ঢাকির বোলেও যাই যাই ভাব, মার চোখের কোণেও দু’ফোঁটা জল নাকি মনের ভুল! আবার ৩৬৫ দিন, আবার জাবর কাটা, বৈচিত্র্য নেই, বাঁধনহারা আনন্দ নেই, কিন্তু ওই তবুও তো আছে কিছু...আছে আসছে পুজোর প্রস্তুতি, তাই তো এমন ব্যাকুল প্রতীক্ষা, এমন আকুল হয়ে দিন গোনা, সে তেরো নদীর এ পার হোক বা ও পার, এ পার বাংলা-ও পার বাংলা দুই বাংলা মিলেমিশে একাকার এই অপেক্ষায়— আসছে বছর আবার হবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন