গরমে লাগাম দিতে বদলাক ঠান্ডা যন্ত্র, জোট ১৯৭ দেশের

ভিড় ট্রেনে ঘামতে ঘামতে রাতের সুখনিদ্রার গুণগান গাইছিলেন বছর পঁচিশের অয়ন দাস। ধর্মতলা এলাকার একটি বেসরকারি সংস্থার চাকুরে অয়ন বলছিলেন, ‘‘এই এসিটুকু আছে বলেই মে মাসের রাতেও নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারি।’’

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:১৭
Share:

ভিড় ট্রেনে ঘামতে ঘামতে রাতের সুখনিদ্রার গুণগান গাইছিলেন বছর পঁচিশের অয়ন দাস। ধর্মতলা এলাকার একটি বেসরকারি সংস্থার চাকুরে অয়ন বলছিলেন, ‘‘এই এসিটুকু আছে বলেই মে মাসের রাতেও নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারি।’’ সকালের ডাউন বনগাঁ লোকালের নিত্যযাত্রী অয়ন আদতে একটি মুখ মাত্র। কিন্তু যে ভাবে গরমের দাপট বাড়ছে, তাতে এসি আজ আর বিলাসিতার উপকরণ নয়। সে ক্রমেই হয়ে উঠছে মধ্যবিত্তের অভ্যাস।

Advertisement

অথচ মধ্যবিত্তের এই ‘সুখনিদ্রাই’ ঘুম কেড়ে নিয়েছে দেশ-বিদেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের! কেন?

কারণ পরিবেশবিদরা বলছেন, এসি থেকে বেরোনো হাইড্রোফ্লুরোকার্বন গ্যাসের প্রভাবে তাপমাত্রা বাড়ছে পৃথিবীর। বিপদ ঘনাচ্ছে গোটা মানবজাতির। তাই শনিবার রোয়ান্ডার রাজধানী কিগালিতে পরিবেশ সম্মেলনে ভারত-সহ ১৯৭টি দেশ ঠিক করেছে, হাইড্রোফ্লুরোকার্বন গ্যাস নিঃসরণে রাশ টানতে হবে। যার বর্তমান পরিমাণ ৯০০০ টন কার্বন ডাই অক্সাইডের সমান!

Advertisement

এই সিদ্ধান্তের পরেই প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি এ বার কোপ পড়বে অয়নদের মতো মধ্যবিত্তের সুখনিদ্রাতেও? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্যের মতে, হাই়ড্রোফ্লুরোকার্বনের বদলে অন্য কোনও রাসায়নিক ব্যবহার করলে নির্মাণ খরচ বেশি হবে। ফলে এসি-র দাম বাড়বে। মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে সেই দাম। একই কথা প্রযোজ্য রেফ্রিজারেটরের ক্ষেত্রেও। কারণ, এসির মতো রেফ্রিজারেটরের কম্প্রেসরেও হাইড্রোফ্লুরোকার্বন গ্যাস ব্যবহার করা হয়। ফলে একই দোষে দুষ্ট সে-ও।

বিশ্ব উষ্ণায়ন ঠেকাতে ২০১৫ সালেও প্যারিসে বৈঠকে বসেছিল ছোট-বড় নানা দেশ। সেই সম্মেলনে ঠিক করা হয়েছে, কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণে জোরালো লাগাম পরাতে হবে। সেই চুক্তি কার্যকরও করতে শুরু করেছে কোনও কোনও দেশ। কিন্তু কার্বন ডাই অক্সাইডের থেকেও হাইড্রোফ্লুরোকার্বন কমানোর উপরে বেশি জোর দিচ্ছেন পরিবেশবিজ্ঞানীরা।

হিসেব যদিও বলছে, হাইড্রোফ্লুরোকার্বনের হার গোটা দুনিয়ার দূষিত বা গ্রিন হাউস গ্যাসগুলির নিরিখে খুবই কম! পরিবেশবিদদের ব্যাখ্যা, হাইড্রোফ্লুরোকার্বন পরিমাণে কম হলেও এর ক্ষতি করার ক্ষমতা কার্বন ডাই অক্সাইডের থেকে অনেক বেশি। কারণ, এক অণু কার্বন ডাই অক্সাইড যতটা তাপ ধারণ করতে পারে, এক অণু হাইড্রোফ্লুরোকার্বন তার থেকে প্রায় হাজার গুণ বেশি তাপ ধারণ করতে পারে। ফলে বিশ্ব উষ্ণায়ন ঠেকানোর ক্ষেত্রে এক অণু হাইড্রোফ্লুরোকার্বন কমানো প্রায় হাজার অণু কার্বন ডাই অক্সাইড কমানোর সমান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এই পথকেই বলেছেন, ‘‘বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দূরদর্শী সমাধান।’’

ঠান্ডা যন্ত্রের থেকে গরম বেড়ে যাওয়ার এই বিপত্তি অবশ্য নতুন কিছু নয়। এক সময় এসি বা রেফ্রিজারেটরে ক্লোরোফ্লুরোকার্বন ব্যবহার করা হতো। সেই ক্লোরোফ্লুরোকার্বন বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করত। ১৯৮৭ সালের মন্ট্রিয়ল প্রোটোকলে ক্লোরোফ্লুরোকার্বনে রাশ টানার কথা বলা হয়েছিল। ধীরে ধীরে পৃথিবীর সব দেশই ক্লোরোফ্লুরোকার্বন কমিয়ে এনেছে। কিন্তু বিষের প্রকোপ কমেনি। তার জায়গা নিয়েছে হাইড্রোফ্লুরোকার্বন। ফলে সেই বিপদ ঠেকাতে মন্ট্রিয়ল প্রোটোকলের দেশগুলিই কিগালির বৈঠকে যোগ দিয়েছিল। যদিও এই চুক্তি হওয়া মানে যে আজ থেকেই এসি, রেফ্রিজারেটরের দাম বাড়বে, তেমনটা অবশ্য নয়। এক ধাক্কায় সব বদলে যাবে এমনও নয়। চিরঞ্জীববাবু বলছেন, হঠাৎ করে হাইড্রোফ্লুরোকার্বনের ব্যবহার বন্ধ করা তো সম্ভব নয়। এর একটি আর্থিক দিকও রয়েছে। ফলে সব দিক মেপেই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে এই ধরনের কাজ করা হয়। যেমন মন্ট্রিয়ল প্রোটোকল কার্যকর হওয়ার পরেও ক্লোরোফ্লুরোকার্বন ব্যবহারে লাগাম টানতে বহু বছর লেগেছিল। হাইড্রোফ্লুরোকার্বনের ক্ষেত্রেও একই ভাবে ধাপে ধাপে কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ঠিক করা হয়েছে, আমেরিকার মতো ধনী দেশগুলি আগে ২০১৮ সালে হাইড্রোফ্লুরোকার্বন ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করবে। তার পরের ধাপে রয়েছে চিন, ব্রাজিলের মতো দেশ। ভারত, পাকিস্তান, ইরান, সৌদি আরব এবং কুয়েতের মতো গরম দেশগুলি ২০২৮ সালে হাইড্রোফ্লুরোকার্বনের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করবে। ভারতের মতো উন্নয়নশীল এবং গরম দেশকে তৃতীয় সারিতে রাখার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন এ দেশের পরিবেশবিদদের অনেকেই। পরিবেশ গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’-এর ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল চন্দ্র ভূষণের মতে, এর ফলে ভারতের পরিবেশ ও অর্থনীতি— দুয়েরই ভারসাম্য বজায় থাকবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন