সুদানে অনাহারক্লিষ্ট শিশুদের খাবার বলতে রয়েছে কেবল পশুখাদ্য। ছবি: রয়টার্স।
প্রায় বছর তিনেক ধরে গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত সুদান। দারফুরের আল ফাশার শহরের শেষ হাসপাতালটিতে এত দিনে ৩০ বারেরও বেশি বোমা হামলা হয়ে গিয়েছে। প্রতি দিন সেখানে সাহায্যের জন্য আসে অন্তত ৩০-৪০ জন অপুষ্টিতে ভোগা শিশু। বেশির ভাগেরই রুগ্ন শরীরে ক’টা হাড় ছাড়া আর কিছু নেই। অথচ হাসপাতালেও সুষম খাদ্য অমিল। নিরুপায় চিকিৎসকেরাও। কারণ, এই মুহূর্তে পশুখাদ্য ছাড়া আর কিছুই খাওয়ার মতো বাকি নেই দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইম্সের একটি প্রতিবেদনে এমনই তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে। চিকিৎসক ওমর সেলিকের কথায়, “রোগীরা তো বটেই, আমরা নিজেরাও পশুখাদ্য খাচ্ছি। কারণ এখানে আর কিছুই খাবার মতো নেই।” আপাতত শহরের বেশির ভাগের খাদ্য চিনাবাদাম থেঁতো করে তৈরি একটি মিশ্রণ, যা সাধারণত গরু, উট এবং গাধাকে দেওয়া হয়।
সুদানের সেনাবাহিনী এবং আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস-এর মধ্যে সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে বছর তিনেক আগে সুদানে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়। তার পর থেকে আফ্রিকার তৃতীয় বৃহত্তম এই দেশে প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ ঘরছাড়া। এখনও পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে হাজার হাজার মানুষের। দেশ জুড়ে দেখা দিয়েছে দুর্ভিক্ষ। সুদানের যে সব এলাকায় এই গৃহযুদ্ধের প্রভাব সবচেয়ে প্রকট, তার একটি হল আল ফাশার। গত প্রায় ১৮ মাসেরও বেশি সময় ধরে দারফুরের পশ্চিমে অবস্থিত এই শহর ঘিরে রেখেছে আধাসামরিক বাহিনী। শহরে এমনিতেই খাদ্যসঙ্কট তীব্র। তার উপর বাইরে থেকে খাবার কিংবা ত্রাণও ঢোকার জো নেই। শহরবাসীর কাছে আপাতত খোলা রয়েছে দু’টি রাস্তা— হয় থাকো, নয়তো পালাও। থেকে যাওয়া মানে সারা ক্ষণ বোমা হামলার ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা কিংবা অনাহারে মরা। আর পালিয়ে গেলেও পরিত্রাণ নেই— পদে পদে রয়েছে খুন, ডাকাতি কিংবা ধর্ষণের ঝুঁকি। তবু চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে এখনও পর্যন্ত আল ফাশার থেকে প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়েছেন ৫,০০,০০০-এরও বেশি মানুষ। আর যে ২,৬০,০০০ মানুষ এখনও ভিটেমাটি আঁকড়ে থেকে গিয়েছেন, তাঁদের জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিসহ।
তাহা খাতের নামে এক ত্রাণকর্মী নিউ ইয়র্ক টাইম্সকে জানাচ্ছেন, শহরে এক কিলো পাস্তার দাম এখন গিয়ে ঠেকেছে ৭৩ ডলারে (ভারতীয় মুদ্রায় ৬,৪৩০ টাকা)। স্বাভাবিক দামের ১০ গুণেরও বেশি দামে বিকোচ্ছে খাবার, যা স্বভাবতই সাধারণের সাধ্যের বাইরে। রাষ্ট্রপুঞ্জের ত্রাণসামগ্রী গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে আল ফাশারে ঢুকতে পারেনি। শহরের ত্রিসীমানায় এলেই ড্রোন হামলায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে ট্রাক, মৃত্যু হয়েছে কর্মীদেরও। গত জুন মাসেই ১৫টি ত্রাণবাহী ট্রাকের সারি লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা হয়, তাতে মৃত্যু হয় পাঁচ ত্রাণকর্মীর। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত দু’সপ্তাহে অপুষ্টিতে শহরের ১৪ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখলে সংখ্যা বাড়বে আরও।
আল ফাশারের বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, যে পক্ষই হামলা করুক না কেন, বেশির ভাগ হামলার অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তু হল হাসপাতাল। গৃহযুদ্ধের আগে আল ফাশারে প্রায় ২০০টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছিল, যার মধ্যে এখন কেবল একটি অবশিষ্ট রয়েছে— আল সৌদি হাসপাতাল। একের পর এক বোমা হামলা, সুষম খাদ্যের অভাব, ক্রমশ কমতে থাকা ওষুধের জোগান— এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সেখানে এখনও এক অসম যুদ্ধ লড়ে যাচ্ছেন মুষ্টিমেয় কয়েক জন চিকিৎসক। এই লড়াই সহজ নয়। গত জানুয়ারি মাসেই সেখানে আরএসএফ-এর ড্রোন হামলায় মৃত্যু হয়েছিল ৭০ জন রোগী এবং স্বাস্থ্যকর্মীর। তাতে দমেননি ডাক্তারেরা। এখন বোমা হামলা হলে সকলে বাঙ্কারে আশ্রয় নেন। অপুষ্টিতে ভোগা, মরণাপন্ন শিশুদের খাওয়ান পশুখাদ্য। তা-ই খান নিজেরাও। স্থানীয় ভাষায় ‘আম্বাজ়’ নামে পরিচিত এই পশুখাদ্য মোটেও নিরাপদ নয়। বর্ষার মরসুমে আম্বাজ়ে জন্মায় এক ধরনের ছত্রাক। তা থেকে সংক্রমণ হয়ে কখনও কখনও মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। গত কয়েক সপ্তাহে আম্বাজ় খাওয়ার পর সংক্রমণে মৃত্যু হয়েছে ১৮ জনের। কিন্তু আর কোনও উপায় নেই। আপাতত এর উপরেই নির্ভর করে রয়েছে প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষের জীবন।