—প্রতীকী চিত্র।
পুত্রসন্তান চায় ক্লারা। তার আশঙ্কা, কন্যা হলে ক্লারার মতোই পরিণতি হবে। আজীবন কষ্ট পেয়ে যেতে হবে। ক্লারার বয়স ১৪ বছর। ছ’মাসের গর্ভবতী সে। ক্লারা একা নয়। ফিলিপিনসে তার মতো কিশোরী মা, যাদের বয়স ১০ থেকে ১৪ বছর, তাদের সংখ্যা হাজার হাজার। তাদের কারও বয়স ১৪, কারও বড় জোর ১৬। এই বয়সে তাদের কেউ কেউ দুই সন্তানের মা। কেউ আসন্নপ্রসবা। গর্ভনিরোধক সংক্রান্ত বিষয়ে কোনও ধারণা নেই ক্লারাদের। স্কুলে গেলেও দেওয়া হয়নি যৌনশিক্ষার পাঠ। বাদ সেধেছে ক্যাথলিক ধর্ম। সরকার গর্ভনিরোধক সংক্রান্ত বিষয়ে কিশোর-কিশোরীদের সচেতন করতে চেয়ে খসড়া বিল তৈরি করেছে কয়েক বছর আগে। কিন্তু গির্জা, ধর্মীয় সংগঠনগুলির বাধায় তা বাস্তবের আলো দেখেনি আজও।
সংবাদমাধ্যমে সিএনএন ফিলিপিনসে ১৪ থেকে ২৩ বছর বয়সি মায়েদের সঙ্গে কথা বলেছে। তাঁদের সকলেরই অভিযোগ, স্কুলে যৌনশিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না তাঁদের। ২৩ বছরের সাম জানিয়েছেন, অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় গর্ভনিরোধক সংক্রান্ত বিষয়ে পাঠ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই সঙ্গে তা ব্যবহার করতে বারণও করে দেওয়া হয়েছিল। ম্যানিলার ডক্টর জোস ফ্যাবেলা মেমোরিয়াল হাসপাতালের চিকিৎসক আইলন মারি রুবিয়ো জানান, যৌন সংসর্গের ফলে ওই কিশোরীরা যে সন্তানসম্ভবা হতে পারে, এই নিয়ে তাদের কোনও ধারণাই ছিল না।
সন্তানধারণের পরে এই কিশোরীদের বেশির ভাগই কোনও চিকিৎসকের পরামর্শ নেয় না বলে অভিযোগ। ক্লারাও তাদের মধ্যে এক জন। সে জানায়, এক বন্ধুর মাধ্যমে প্রেমিকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সম্পর্কের ছ’মাসের মাথায় সন্তানধারণ করে। ছ’মাস পেরিয়ে গেলেও চিকিৎসকের কাছে যেতে পারেননি, কারণ তার কাছে কোনও টাকা নেই। চিকিৎসকেরা মনে করছেন, এই কারণে কিশোরী মা এবং তার সন্তানের প্রাণের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
গোটা এশিয়ার মধ্যে শিশু এবং কিশোরীদের সন্তানধারণের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ফিলিপিনসে। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালে সে দেশে ১৫ থেকে ১৯ বছরের কিশোরীদের মা হওয়ার ঘটনা তুলনামূলক কমেছে। কিন্তু ১৪ বা তার কমবয়সিদের মা হওয়ার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯ সালে ১৪ বা তার কমবয়সি মায়ের সংখ্যা ছিল ২,৪১১। ২০২৩ সালে তা বেড়ে হয় ৩,৩৪৩।
অনেক দিন আগেই ফিলিপিনসে কৈশোরে সন্তানধারণকে ‘জাতীয় সামাজিক সঙ্কট’ বলে অভিহিত করেছে সে দেশের সরকার। তারা ২০২২ সালে কৈশোরে সন্তানধারণ প্রতিরোধ বিলের (অ্যাডোলেসেন্ট প্রেগন্যান্সি প্রিভেনশন বিল) প্রথম খসড়া প্রকাশ করে। মাঝে বার বার সংশোধনী হয়েছে। তার পরেও আইনে পরিণত হয়নি। কারণ বিলের বিরোধিতা করেছে ধর্মীয় সংগঠন এবং গির্জাগুলি।
কী রয়েছে বিলে?
স্কুলে যৌনশিক্ষা চালু করার কথা বলে হয়েছে বিলে। কিশোর-কিশোরীরা যাতে যৌন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সব রকম পরিষেবা পায়, তা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে বিলে। এখন সে দেশে ১৮ বছরের কমবয়সিরা গর্ভনিরোধক পেতে চাইলে অভিভাবকের অনুমতির প্রয়োজন হয়। বিলের অন্যতম প্রণেতা রিসা হন্টিভেরোস জানিয়েছেন, বয়সন্ধিতে থাকা ছেলেমেয়েরা যাতে নিজেদের রক্ষা করতে পারে, তাই বিল পাশ করানো প্রয়োজন।
কেন আপত্তি গির্জার?
বিল নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে ক্যাথলিক গির্জা। ফিলপিনস ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী। ক্যাথলিক গির্জা মনে করে, শুধু বিবাহিত দম্পতির মধ্যেই যৌন সম্পর্ক থাকা উচিত। কৃত্রিম গর্ভনিরোধকেরও বিরোধিতা করে গির্জা। একমাত্র বিবাহিত দম্পতির প্রাকৃতিক উপায়ে গর্ভনিরোধককেই সমর্থন করে তারা। বিলের বিরোধিতা করে সক্রিয় হয় দেশের আটটি ক্যাথলিক সংগঠন। অভিযানের নাম হল ‘প্রজেক্ট ডালিসায়’। তার নেতৃত্বে থাকা ফিলিপিনসের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি মারিয়া লুর্দ সেরেনো জানিয়েছেন, স্কুলে যৌনশিক্ষার প্রচলন কখনই দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খায় না। বিলের বিরোধিতায় সই সংগ্রহ শুরু করেছেন সংগঠনের সদস্যেরা। তাঁদের সমর্থন জানিয়েছে আমেরিকার গর্ভপাত-বিরোধী সংগঠন ‘হিউম্যান লাইফ ইন্টারন্যাশনাল’। সেরেনো যদিও দাবি করেছেন, আমেরিকার এই সংগঠনের থেকে কোনও আর্থিক সাহায্য নিচ্ছে না ‘প্রজেক্ট ডালিসায়’।
চাপে পড়ে গত জানুয়ারিতে ফিলিপিনসের বেশ কয়েক জন সেনেটর আগে বিলকে সমর্থন করলেও পরে তা তুলে নেন। প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়র জানান, তিনি ‘ভেটো’ দেবেন। যদিও আগে প্রকাশ্যে বিলকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। এর পরে বিলে সংশোধন আনা হয়। সূত্রের খবর, গর্ভপাত, গর্ভনিরোধকের বিষয়টিও বিল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। গত মাসে সংশোধিত বিল পেশ করা হয়। তা নিয়ে এখন বিভিন্ন কমিটিতে শুনানি চলছে।
আর তার ফল ভুগছে ফিলিপিনসের কিশোরীরা। চিকিৎসকেরা বলছেন, বেশির ভাগ কিশোরী সন্তান ধারণের পরে ‘সামাজিক লজ্জা’য় স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়। নিজের পরিবারের লোকজনই দূরত্ব তৈরি করেন। অর্থের অভাবে ওই কিশোরীরা চিকিৎসকের কাছেও যেতে পারে না। এর ফলে সময়ের আগে প্রসব, প্রসবের সময় মা এবং সন্তানের বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার সম্ভাবনা তৈরি হয়। কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। কিন্তু তাতে দীর্ঘকালীন সমাধান হয় না। ক্লারারা আশা করে যায়, এক দিন হয়তো স্কুলে যেতে পারবে। তাদের সন্তানেরা হয়তো আর একটু ভাল ভাবে বাঁচবে!