ওসমান হাদির শেষকৃত্যে ঢাকায় মানুষের ঢল। ছবি: পিটিআই।
ময়মনসিংহে এক যুবককে পিটিয়ে খুন এবং দেহ জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনায় শনিবার রাতে গ্রেফতার করা হল আরও তিন জনকে। বিবৃতি দিয়ে এ কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস। ফলে সব মিলিয়ে ওই ঘটনায় ধৃতের সংখ্যা বেড়ে হল ১০।
বৃহস্পতিবার রাতে ওসমান হাদির মৃত্যুসংবাদ দেশে পৌঁছোনো মাত্র বাংলাদেশের নানা প্রান্তে উত্তেজনা ছড়ায়। বিভিন্ন সরকারি ভবন, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভাঙচুরের পাশাপাশি আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় দেশের প্রথম সারির দুই সংবাদপত্র ‘প্রথম আলো’ ও ‘দ্য ডেলি স্টার’-এর দফতরে। দেশজোড়া অশান্তির মাঝে খুলনা ও ময়মনসিংহে খুন হন দুই যুবক। ভাঙচুর চলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ভগ্ন বাড়িতেও। হাদির খুনিদের গ্রেফতার কবে করা হবে, জবাব চেয়ে ইউনূস সরকারকে ২৪ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে হাদির দল। সময়সীমার মধ্যে সদুত্তর দিতে না-পারলে অন্তর্বতী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও সহকারী উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি জানানো হয়েছে।
ময়মনসিংহে যুবককে পিটিয়ে খুন এবং দেহ জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনায় ধৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১০। শনিবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার দফতর থেকে বিবৃতি জারি করে এ কথা জানানো হয়েছে। ইউনূস বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘ময়মনসিংহের ভালুকায় দীপুচন্দ্র দাসকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় দশ জনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাঁদের মধ্যে সাত জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং তিন জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।’’
ধৃতদের নামও প্রকাশ করেছে প্রধান উপদেষ্টার দফতর। র্যাবের হাতে ধৃতেরা হলেন মহম্মদ লিমন সরকার, মহম্মদ তারেক হোসেন, মহম্মদ মানিক মিয়া, এরশাদ আলি, নিজুম উদ্দীন, আলমগির হোসেন এবং মহম্মদ মিরাজ হোসেন আকন। পুলিশের হাতে ধৃতদের নাম মহম্মদ আজমল হাসান সগীর, শাহিন মিয়া এবং মহম্মদ নাজমুল। দীপু দাস নামে বছর ২৭-এর নিহত যুবক স্থানীয় একটি পোশাকের কারখানায় কাজ করতেন। বৃহস্পতিবার রাতে তাঁকে ঘিরে ধরে বেধড়ক মারধর করে উন্মত্ত জনতা। তাতে যুবকের মৃত্যু হয় এর পর দেহটি গাছের সঙ্গে বেঁধে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় তাতে। সেই ভিডিয়ো দ্রুত সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার রাতেই ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পর দীপুর দেহের অবশিষ্টাংশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়।
হাদির শেষকৃত্যের পর শনিবার বিকেলে শাহবাগ চত্বরে জমায়েতের ডাক দেওয়া হয়েছিল। জমায়েত থেকেই ইউনূস সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা তথা লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক) খোদাবক্স চৌধুরীকে ২৪ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। ইনকিলাব মঞ্চের তরফে আবদুল্লা আল জাবের বলেন, ‘’২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের জনসমক্ষে এসে বলতে হবে, গত এক সপ্তাহে তদন্ত কত দূর এগিয়েছে। এর জবাব না-দিতে পারলে তাঁদের পদত্যাগ করতে হবে।’’ এ ছাড়া, নির্বাচন বানচাল করতে দেশ-বিদেশ থেকে ষড়যন্ত্র চলছে বলেও দাবি করেন জাবের। দেশবাসীকে শান্ত থাকা এবং কোনও প্ররোচনায় পা না-দেওয়ার আর্জি জানান তিনি।
শনিবার দুপুরে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজ়ায় হাদির শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। হাদিকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস। এ ছাড়াও ছিলেন তাবড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যেরা। সংসদ ভবনের সামনে ছিল কাতারে কাতারে মানুষের ভিড়। নমাজের আগে ইউনূস বলেন, ‘‘তোমাকে আমরা বিদায় জানাতে আসিনি আজ। তুমি আমাদের বুকের ভিতরে আছ, সব বাংলাদেশির বুকের ভিতরে আছ।’’ সে সময়েও হাদির পরিবার ও ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যদের পক্ষ থেকে হাদির খুনিদের গ্রেফতারি ও চরম শাস্তির দাবি জানানো হয়। এর পর দুপুর সাড়ে ৩টে নাগাদ হাদির দেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে কেন্দ্রীয় মসজিদে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধির পাশে সমাধিস্থ করা হয় তরুণ নেতাকে। এর আগে একাধিক শিক্ষক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে সমাধিস্থ করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই নির্দিষ্ট চত্বরে। সেখানেই কবরস্থ করা হয় হাদির মরদেহ।
শনিবার দুপুরে হাদির শেষকৃত্য ঘিরে সংসদ ভবনের সামনে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। নমাজ শেষ হতেই বাংলাদেশের স্থানীয় সময় অনুযায়ী বেলা আড়াইটে নাগাদ উপস্থিত জনতার একাংশ জোর করে সংসদ ভবনে প্রবেশের চেষ্টা করেন বলে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর। সেখানে অবস্থানরত সেনার সদস্যেরা তাঁদের বাধা দেন। মুহূর্তের মধ্যে সংসদে প্রবেশের গেটগুলি ঘিরে ফেলেন সেনা। কড়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বেঁধে ফেলা হয় ভবনের চার দিক। মাইকে সকলকে সরে যাওয়ার অনুরোধ করতে থাকেন সেনা সদস্যেরা। যদিও যাঁরা সংসদে ঢোকার চেষ্টা করছিলেন, তাঁরা সরেননি। বেশ কিছুক্ষণ ধরে তাঁরা সেনার কর্ডনের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন বলে খবর। পরে অবশ্য ধীরে ধীরে ভিড় ফাঁকা হতে থাকে।
শুক্রবার রাতে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের লক্ষ্মীপুর জেলায় বিএনপি নেতা বেলাল হোসেনের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় একদল যুবক। বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় বাড়িতে। আগুনে ঝলসে মৃত্যু হয় তাঁর সাত বছরের শিশুকন্যার। বেলাল ও তাঁর অন্য দুই নাবালিকা কন্যা গুরুতর জখম অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বেলাল লক্ষ্মীপুরের ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের দলের সহকারী সাংগঠনিক সম্পাদক পদে রয়েছেন। স্থানীয় সূত্রে খবর, শুক্রবার রাতে যখন বেলাল এবং তাঁর পরিবারের সদস্যেরা ঘুমোচ্ছিলেন, সেই সময় রাত ২টো নাগাদ কয়েক জন উন্মত্ত ব্যক্তি সদর দরজায় তালা লাগিয়ে বেলালদের বাড়িতে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। বিএনপি নেতার পরিবার কিছু বুঝে ওঠার আগেই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। দরজা তালাবন্ধ থাকায় পালাতেও পারেননি কেউ। ঘটনাস্থলেই আগুন ঝলসে মৃত্যু হয় বেলালের সাত বছরের কন্যা আয়েশা আক্তারের। গুরুতর জখম হন বেলাল এবং তাঁর অন্য দুই কন্যা বীথি আক্তার এবং স্মৃতি আক্তার। ঘটনার নিন্দায় সরব হয়েছে খালেদা জিয়ার দল।
হাদির শেষকৃত্যের জমায়েত থেকে হিংসা ছড়াতে পারে, এই মর্মে বাংলাদেশে থাকা নাগরিকদের আগেভাগেই সতর্ক করেছিল আমেরিকা। জমায়েতের কারণে শনিবার ঢাকায় ব্যাপক যানজট হতে পারে বলেও জানানো হয়েছিল। সতর্কবার্তায় আমেরিকার বিদেশ দফতরের তরফে শেষকৃত্যের সময় মার্কিন নাগরিকদের ঢাকা এবং সংলগ্ন এলাকা এড়িয়ে চলতে বলা হয়। হাতে সময় নিয়ে বেরোনো, স্থানীয় সংবাদসংস্থাগুলির উপর নজর রাখার পরামর্শও দেওয়া হয় তাঁদের।
এক দিন বন্ধ থাকার পর শনিবার প্রকাশিত হয়েছে সংবাদপত্র প্রথম আলো এবং ডেলি স্টার। শুক্রবার এই দুই পত্রিকার কোনও সংস্করণ প্রকাশ করা যায়নি। অফলাইন ও অনলাইন মাধ্যমে কাজ বন্ধ ছিল দীর্ঘ ক্ষণ। ওই দুই সংবাদপত্রের দীর্ঘ ইতিহাসে এমন পরিস্থিতি কখনও আসেনি বলে জানাচ্ছেন কর্মীরা। বৃহস্পতিবার রাতে দু’টি দফতরেই দীর্ঘ ক্ষণ ধরে তাণ্ডব চলে। ভিতরে আটকে পড়েন সাংবাদিকেরা। সমাজমাধ্যমে বাঁচানোর আর্তি জানান তাঁরা। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর ক্রেনের সাহায্যে দগ্ধ বহুতল থেকে উদ্ধার করা হয় তাঁদের। সংবাদপত্রের দফতরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় এখনও কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। তবে তদন্ত শুরু হয়েছে। দুই সংবাদপত্রের ক্ষতিগ্রস্ত দফতর পরিদর্শন করেছেন ঢাকা পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্তারাও।
প্রথম আলো-র যে মুদ্রিত সংস্করণ শনিবার প্রকাশিত হয়েছে, তার প্রথম পাতার প্রথম খবরের শিরোনাম— ‘প্রথম আলো-ডেলি স্টার আক্রান্ত’। বৃহস্পতিবার রাতের ঘটনাপ্রবাহ এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়ার কথা এই প্রতিবেদনে রয়েছে। অন্য দিকে, ডেলি স্টার-এর প্রথম পাতার শিরোনামে রয়েছে একটিই শব্দ— ‘আনবাওড’ (আপসহীন)! হামলা বা হুমকির সামনে মাথা নত না করার বার্তা দিয়েছে এই পত্রিকা। দুই পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে শুক্রবার টেলিফোনে কথা বলেছেন ইউনূস। তাঁদের উপর হামলার নিন্দা করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে বার্তা দিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে শুক্রবার রাতে বিবৃতি জারি করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। রাষ্ট্রপুঞ্জের তরফে জানানো হয়েছে, হাদির হত্যার নিরপেক্ষ তদন্ত প্রয়োজন। তবে বাংলাদেশকে সংযত হতে হবে। রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তোনিয়ো গুতেরেস হাদি-হত্যার বিরোধিতা করে বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নিরপেক্ষ এবং স্বচ্ছ তদন্ত’ করতে হবে। ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে তদন্তপ্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করার প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা। আপাতত ভোটের কথা মাথায় রেখেই সংযত হওয়া দরকার বলে মনে করছে রাষ্ট্রপুঞ্জ।
গত ১২ ডিসেম্বর ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হন হাদি। টানা ছ’দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ের পর বৃহস্পতিবার রাতে তাঁর মৃত্যুসংবাদ প্রকাশ্যে আসে। উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারি উদ্যোগে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সিঙ্গাপুরে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। এর পরেই তাণ্ডব শুরু হয় দেশ জুড়ে। প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের আবেদন উড়িয়ে রাতভর হামলা চালায় উত্তেজিত জনতা। ভাঙা হয় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সংস্কৃতিকেন্দ্র ছায়ানট ভবন, উদীচীর কার্যালয়। শুক্রবার সন্ধ্যায় সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশে পৌঁছোয় হাদির মরদেহ। শনিবার দুপুরে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজ়ায় নিহত নেতার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। হাদিকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে সংসদ ভবনের সামনে জড়ো হয়েছিলেন কাতারে কাতারে মানুষ। দুপুর সাড়ে ৩টে নাগাদ হাদির দেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে কেন্দ্রীয় মসজিদে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধির পাশে সমাধিস্থ করা হয় তরুণ নেতার দেহ।