প্রান্তরের দিকে দিকে উড়ছে মৃত্যুর নিশান

এখন সকাল, দুপুর না সন্ধে! ঠাওর করা মুশকিল। কেমন যেন কালো চাদর মুড়ি দিয়ে রয়েছে চারপাশ। গাছপালা, শস্যের খেত। বিপর্যয়টা ঘটে গিয়েছে বেশ কয়েক ঘণ্টা আগে। এখনও এত ধোঁয়া আসে কোথা থেকে? বাতাস ভারী পোড়া গন্ধে। পোড়া তেল। পোড়া মাংস। একটানা কুকুর ডেকে চলেছে। অ্যাম্বুল্যান্স আর উদ্ধারকারী গাড়ির করুণ সাইরেন।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৪ ০৩:৪৯
Share:

পোড়া মাংসের গন্ধ লাগছে নাকে। তার মধ্যেই চলছে উদ্ধারকাজ। শুক্রবার গ্রাবোভো গ্রামের কাছে । ছবি: এএফপি।

এখন সকাল, দুপুর না সন্ধে!

Advertisement

ঠাওর করা মুশকিল। কেমন যেন কালো চাদর মুড়ি দিয়ে রয়েছে চারপাশ। গাছপালা, শস্যের খেত। বিপর্যয়টা ঘটে গিয়েছে বেশ কয়েক ঘণ্টা আগে। এখনও এত ধোঁয়া আসে কোথা থেকে?

বাতাস ভারী পোড়া গন্ধে। পোড়া তেল। পোড়া মাংস। একটানা কুকুর ডেকে চলেছে। অ্যাম্বুল্যান্স আর উদ্ধারকারী গাড়ির করুণ সাইরেন।

Advertisement

চারপাশে ছোট ছোট সাদা কাপড় হাওয়ায় উড়ছে। কাছে গেলে দেখা যাবে, প্রত্যেকটা কাপড়ের টুকরোর পাশে একটা করে মৃতদেহ। কোনও কোনও দেহ এখনও সিট বেল্ট দিয়ে বিমানের ছোঁড়াখোঁড়া আসনের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে। অর্ধেক ঝলসানো, মুখে রক্ত। ইউক্রেনের গ্রামের এই বিশাল প্রান্তরে কোথায় কোথায় পড়েছে এমএইচ-১৭ উড়ানের হতভাগ্য যাত্রীদের লাশ, সেই জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে উদ্ধারকারী দলের সদস্যরাই বেঁধে দিয়েছেন ওই কাপড়ের টুকরো। কোথাও ঝোপে, কোথাও শুকনো গাছের ডালেই সাদা কাপড় বেঁধে মাটিতে পোঁতা।

যেন ডালে ডালে মৃত্যু-নিশান!

২৯৫ জন যাত্রী-বিমানকর্মী নিয়ে মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৭৭ বৃহস্পতিবার দুপুরে ক্ষেপণাস্ত্রের ঘা খেয়ে আছড়ে পড়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সীমান্তে এই গ্রাবোভো গ্রামের কাছেই। সেই গ্রাম এখন মৃত্যুপুরী। গ্রামবাসীদের চোখেমুখেও হিমশীতল মৃত্যুর আতঙ্ক প্রকট।

এক গ্রামবাসী বলেন, “আমি ট্রাক্টর নিয়ে মাঠে কাজ করছিলাম। হঠাৎ একটা ভয়ঙ্কর শব্দে চারদিক কেঁপে উঠল। তার পরেই দেখলাম একটা বিশাল বিমান মাটিতে পড়ে দু’টুকরো হয়ে গেল। চার দিক তখন কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গিয়েছে।” আর এক বাসিন্দা আলেকজান্দার জানান, তিনিও তখন মাঠে কাজ করছিলেন। হঠাৎ প্রায় ১০০ মিটার দূরে একটা ভয়ঙ্কর শব্দ। তাঁর কথায়, “যেন আকাশ থেকে নেমে এল সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত।”

মৃত্যুদূতই বটে। গোটা প্রান্তর জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে দৈত্যকার বিমানের টুকরো টুকরো অংশ। সেই ধ্বংসাবশেষ মাঠ পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে রাস্তাতেও। কোথাও পড়ে বিমানের ভাঙা টিভির অংশ। তার পাশেই লেজের খানিকটা। কোথাও আবার গোলাপি রঙা বাচ্চাদের বই। বিমানে তো ৮০ জন শিশুও ছিল! শুধু বই নয়, খেলনাও ছড়িয়ে রয়েছে রাস্তায়। কয়েকটা চটি। ছেঁড়া ব্যাগ থেকে উঁকি মারছে মুখে মাখার ক্রিম। একটা লাল সুটকেস। এমনকী একটা সাইকেলও। প্রায় অক্ষত!

এবং ৩৩ হাজার ফুট থেকে পড়া সারি সারি দেহ। এক মহিলার দেহের আব্রু বলতে কালো সোয়েটারটুকু। মুখ থেকে তখনও বেরিয়ে আসছে রক্ত। কিছু দূরে আর এক মহিলার দেহ। সোনালি চুল লুটোচ্ছে ঘাসে। এক পুরুষের দেহ ক্ষতবিক্ষত, অথচ জুতো দু’টি অক্ষত। একটি মৃতদেহের পাশে আই ফোন। মরে পড়ে রয়েছে একটা মুরগি, দু’টো টিয়া আর একটা ময়ূর।

চারপাশে চোখ বুলিয়ে শিউরে উঠেছেন উদ্ধারকারী দলের সদস্য, গ্রামবাসী এমনকী ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার অভিযোগ যাদের দিকে, সেই রুশপন্থী জঙ্গিরাও। উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে তারাও। সের্গেই নামে এক জঙ্গির মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল “কী ভয়ঙ্কর!”

তবে কি এটা আপনাদের কাজ নয়? এক সাংবাদিক প্রশ্নটা ছুড়ে দিতেই তাঁর দিকে কিছু ক্ষণ ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে রইলেন এক জঙ্গি। তার পরেই চিৎকার, “আমরা কি জানোয়ার?”

উদ্ধারকারীদের দলে যোগ দিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারাও। ভিক্টর নামে এক গ্রামবাসীর দাবি, “আমি তখন বাগানে ঘুরছিলাম। হঠাৎ একটা রকেটের আলো দেখতে পেলাম। আমি নিশ্চিত, ওটা রকেটই ছিল।” ওলেগ জর্জেভিক নামে বছর চল্লিশের এক বাসিন্দা আবার বলেন, “আমি এমন কিছু দেখিনি। শুধু একটা হুইসলের শব্দ শুনি। তার পরেই ছুটে গিয়ে দেখি, মাঠে একটা বিমান ভেঙে পড়েছে।”

প্রান্তরের একধারে তাঁবুতে জমে উঠেছে মৃতদেহের স্তূপ। এখনও পর্যন্ত ১৮৫টা দেহ। সেখানেই শোয়ানো বছর দশেকের এক ছেলের পরনের লাল গেঞ্জিতে লেখা, ‘আতঙ্কে ভুগো না’!

ছেলেটা নিজে অবশ্য আতঙ্কের কবল এড়িয়ে অনেক দূরে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন