রক্তাক্ত শৈশব। হাসপাতালের পথে আহত মেয়েটি। ছবি: এএফপি।
দুপুরবেলা বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটা। অবাক বিস্ময়ে দেখছিল ইজরায়েলি সেনার মার্চ। ওরা সবাই এক রকম জামা পরেছে কেন? দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল দু’বছরের নেমা। জবাব দেওয়ার সুযোগ পাননি বাবা। গাজার ত্রাণশিবিরে বসে সে দিনের কথা বলছিলেন ফাদি আবু আল ফউল। বলছিলেন, পলক ফেলার আগেই একটা আগুনের গোলা উধাও করে দিল নেমাকে। সারা দিন সারা রাত খুঁজে একটা পাথরের তলা থেকে ক্ষতবিক্ষত নেমাকে বার করেন তিনি। নেমা এখন চিকিৎসাধীন। ফাদি বলেন, “আমার নেমা ভাগ্যবান। ও এখনও বেঁচে আছে সেটাই অনেক। আমাদের শহরের প্রায় সব বাচ্চাই মারা গিয়েছে। আমার মেয়েটা অন্তত বেঁচে তো আছে! রাস্তাঘাটে এখনও ছড়িয়ে আছে শিশুদের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন দেহ।”
ফাদির মুখে মেয়ের কথা শুনে তাঁর শিবির-পড়শি হামিদ বেসানও বললেন তাঁর দুই সন্তানের মৃত্যুর কথা। একদা মধ্য গাজার বাসিন্দা জানালেন, তাঁর বাড়ির আশপাশ এখন শিশুশূন্য হয়েছে। সারি দিয়ে রাখা সাদা চাদর মোড়া শিশুদের দেহগুলোর কথা ভেবে এখনও বিনিদ্র রাত কাটছে তাঁর। পনেরো দিনের এই সংঘর্ষে অন্তত ১৫৪ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্যালেস্তাইনের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের মুখপাত্র আশরাফ আল-কেদরা। একই তথ্য দিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জও। গাজার আল শিফা হাসপাতালে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “ইজরায়েলি সেনা কাউকে রেহাই দিচ্ছে না। বাবা-মা-ছেলে-মেয়ে সবাইকে মারছে। লোকভর্তি বাড়িতে অতর্কিতে হামলা করে সবাইকে মেরে ফেলছে। বাচ্চাদের ধরে ধরে মারছে।”
২০১২ সালে ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনের আট দিনের সংঘর্ষে ৩৪ জন শিশুর মৃত্যু হয়। এ বার পনেরো দিনের যুদ্ধে সেই সংখ্যা চার গুণ ছাড়িয়ে গিয়েছে। এত শিশুমৃত্যর জন্য ইজরায়েলের অস্ত্রকেই দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞেরা। জেনিভার আন্তর্জাতির শিশু প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানের গবেষক মহম্মদ আবু রুকবা। তাঁর কথায়, “ইজরায়েল ভয়ানক সব মারণাস্ত্র প্রয়োগ করছে। এক ঝটকায় চার-পাঁচ তলা বাড়ি গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। বড়রা সেখান থেকে কোনও ভাবে বেরিয়ে পড়লেও বাচ্চারা পারছে না।” তিনি আরও জানান, গাজায় বেশির ভাগ শিশুই মাথা, বুক, পাঁজরে ক্ষতের জন্য মারা যাচ্ছে। তাঁর মতে, কংক্রিটের স্তূপের তলায় চাপা পড়ে থাকাই এই চোটের কারণ।
ইজরায়েলের ‘বিশেষ’ অস্ত্রের কথা উড়িয়ে দিচ্ছেন না গাজার আল শাইফা হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞেরাও। চিকিৎসক নবিল হাল আদাল বলেন, “বেশিরভাগ শিশুই ভাঙা বাড়ির তলায় চাপা পড়ে জখম হচ্ছে। আর যারা বোমার আঘাত নিয়ে ভর্তি হচ্ছে, তারা কেউ কথাই বলতে পারছে না। বলছে, মনে হচ্ছে হাজারটা সূচ শরীরে বিঁধে রয়েছে।” ওষুুধ-অস্ত্রোপচারেও সে যন্ত্রণা কমছে না বলে জানান তিনি। ব্রিটেনের একটি সংবাদপত্র জানিয়েছে, ইজরায়েলের ‘ফ্লিচেট সেল’ শরীরে ৪ সেন্টিমিটার লম্বা একটি ধাতব যৌগ ছড়িয়ে দিচ্ছে। সেই আঘাত সহ্য করতে পারছে না শিশুরা। যদিও আন্তর্জাতিক নিয়ম লঙ্ঘন করেই ‘ফ্লিচেট সেল’ ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে খোদ ইজরায়েলের মানবাধিকার কমিশন। শিশুমৃত্যুর বিবরণ কথা বলতে গিয়ে শিউরে উঠছিলেন হাসপাতালের চিকিৎসক-কর্মীরাও। শরণার্থী শিবিরের আনাচে কানাচে এখন সন্তানশোক। শিবিরের এক কোণে এখনও নিহত মেয়ের পুতুলটা আঁকড়ে বসে ছিলেন ৪২ বছরের রাবিয়া আবু জোমা। দেড় বছরের মেয়ের কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন, “প্রার্থনা করব, ইজরায়েলের কোনও শিশুকে যেন এ ভাবে মরতে না হয়।” রাবিয়াকে আশ্বস্ত করলেন ফাদি। বললেন, নেমা এক বার হাঁটতে পারলে রাবিয়ার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবেন।
আশার শেষ আলোটাও দেখালেন সেই ফাদিই। জানালেন, তাঁর স্ত্রী দাহরা এখন সন্তানসম্ভবা। বললেন, “ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা, যুদ্ধ শেষ হলে আমার সন্তানেরা আবার যেন রাস্তায় নেমে খেলতে পারে।”