আমার অল্প বয়সে একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। শোভাবাজার ঘাটের কাছে জাহাজবাড়ি বলে একটা বাড়ি আছে। ওই জাহাজবাড়িতে সমস্ত যাত্রা কোম্পানির গোডাউন ছিল। সেই বছর, আমাদের পাড়ায় কালীপুজোর পরে একটা অনুষ্ঠান হওয়ার কথা, সেই উপলক্ষ্যে লোকনাট্য যাত্রা সংস্থা নামক এক সংস্থাকে বুক করতে গিয়েছিলাম। এই সংস্থা সমস্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ঘটনার উপর নাটক করত, যেমন সুভাষচন্দ্র, কার্ল মার্ক্স, এ সব চরিত্র নিয়ে কাজ করত ওরা।
আরও পড়ুন:
এই লোকনাট্য যাত্রা সংস্থাকে বুক করার জন্য আমরা এক দিন সন্ধ্যাবেলা ভুল করে ওখানে চলে যাই। ওদের গোডাউন ছিল শিবপুরে, কিন্তু আমরা ভেবেছিলাম ওখানেই ওদের অফিস। না জেনেই সন্ধ্যা রাতে, ওই ধরুন ৭.৩০-৮ টা নাগাদ ওই বাড়িতে আমরা ঢুকেছি। জমিদার বাড়ির যেমন গেট হতো আগেকার দিনে, তেমন বিশাল গেট। আমরা যখন ওই বাড়ির প্রায় ১২ ফুটের গেট খুলে ভিতরে ঢুকি দেখি গোটা বাড়িটাই প্রায় অন্ধকার। বিদ্যুৎ নেই মনে হচ্ছিল। তখনই একটা কনফিউশন তৈরি হয় যে এই বাড়িতে কি ঢোকা ঠিক হবে? তখন আমাদের মধ্যে এক জন বলে ওঠে যে ‘না, আমি জানি এই বাড়িতেই দোতলায় ওদের অফিস আছে। হয়তো লোডশেডিং হয়েছে’। আমরা তাই দোনোমনো করে উপরে উঠতে শুরু করি। কোথাও রেলিং ভাঙা, কোথাও অবস্থা খারাপ। তার মধ্যে দিয়েই দোতলায় উঠে দেখি একটা ঘরের জানালা সামান্য খোলা, সেখান দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভিতরে কুপির আলো জ্বলছে। মানে কেরোসিন তেল দিয়ে যে ছোট প্রদীপ জ্বালানো হত আর কী! আমরা সেই আলো দেখেই ভিতরে কেউ আছে ভেবে জিজ্ঞেস করি যে লোকনাট্য যাত্রা সংস্থার অফিস কোথায়? গুরুগম্ভীর গলায় জবাব আসে ‘জানি না, উপরে যান’। আমাদের তখন একটু গা ছমছম করতে শুরু করে। একে অত বড় ভুতুড়ে বাড়ি। তাও আমরা সিঁড়ি দিয়ে তিন তলায় উঠি। ওখানে গিয়েও দেখি একই ভাবে একটা জানালার ফাঁক দিয়ে কুপির আলো জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। আমরা খুব ঘাবড়ে যাই সেটা দেখে। একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি। কিন্তু কোনও সাড়া শব্দ পাই না। তখন আমরা বাধ্য হয়ে চারতলার ছাদে উঠেছি, সে আগেকার দিনের বিশাল কারুকাজ করা ছাদ। গঙ্গা দেখা যাচ্ছে, হাওয়া আসছে। নিচ থেকে নানা ধরনের শব্দ পাচ্ছি। তখন আমরা দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করি।
তিনতলা পাড় করছি যখন, তখন নামার সময় কেউ আমাদের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে ‘কেন এসেছ এই বাড়িতে তোমরা? পালিয়ে যাও। পালিয়ে যাও’। সেই গলা শুনে এত ভয় পেয়ে যাই যে আমরা দৌড়ে নামতে শুরু করি। আর তাতেই ভুল করি। যে দিকে বেরোনোর রাস্তা সেদিকে না গিয়ে, বাঁ দিকে চলে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি রাস্তা শেষ, জলের শব্দ আসছে, আর কুপির আগুন জ্বলছে। জমিদার বাড়িগুলিতে এমন অনেক গোপন রাস্তা ছিল। আমরা ওখানে যাওয়ার পর এক বৃদ্ধার খনখনে গলার শব্দ পাই, আমাদের বলে ‘তোমরা এখানে কেন এলে? বাঁচতে চাও তো পালাও, পালাও’। তখন আমরা দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে আসি। নভেম্বর মাসেও দরদর করে ঘামছিলাম সবাই। বেরিয়ে আমরা একটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়াই, তখন সেখানকার সবাই বলেন, ‘আপনারা রাতে কেন এই বাড়িতে গিয়েছিলেন? রাতে এখানে কেউ যায় না’। আজও সেই বাড়ি আছে। স্ট্র্যান্ড রোড থেকে দেখা যায়।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।