বছরের গোড়াতেই চমক দিয়েছিলেন। বক্স অফিসে দারুণ সাড়া ফেলেছিল তাঁর ‘বিনোদিনী একটি নটীর উপাখ্যান’। তার পর কেটে গিয়েছে বেশ কয়েকটি মাস। আগামী নভেম্বরে আসছে সেই রামকমল মুখোপাধ্যায়ের পরবর্তী ছবি ‘লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল’। বর্তমানে দারুণ ব্যস্ত তিনি। আর তারই ফাঁকে আনন্দবাজার ডট কমের সঙ্গে আড্ডা জমল তাঁর।
পুজোর পরপরই মুক্তি পাচ্ছে ছবি, ফলে এখন দারুণ ব্যস্ততায় সময় কাটছে পরিচালকের। তার ফাঁকে পুজোর কোনও পরিকল্পনা হল কিনা জানতে চাইলে রামকমল মুখোপাধ্যায় বলেন, ''পুজোর পরিকল্পনা তেমন কিছু নেই। ভেবেছিলাম যে কিছু পরিকল্পনা করব, কিন্তু ওই কথাতে আছে না ‘মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক’। যেহেতু ইতিমধ্যেই ‘লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল’-এর মুক্তির দিন ঘোষণা হয়ে গিয়েছে তাই কাজের চাপ অনেক বেশি। মূলত ছবির পোস্ট প্রোডাকশন নিয়েই ব্যস্ত থাকব, কলকাতা-মুম্বই মিলিয়ে মিশিয়ে পুজো কাটবে। ফলে বহু বছর পর কলকাতায় পুজো কাটাব, সেটা নিয়ে অবশ্যই উত্তেজিত। বিগত ২৫ বছর এখানকার পুজো দেখিনি, কতটা বদল এসেছে সেটা দেখার উদ্দীপনা থাকবে। শুনেছি এখন খুব ভিড় হয়, আমাদের ছোটবেলার সময় তো পঞ্চমী থেকে পুজো শুরু হতো, কিন্তু এখন শুনছি মহালয়া থেকেই ভিড় হয়। সপ্তমী, অষ্টমী এখানে ঠাকুর দেখব, কিছু ভাল প্যান্ডেলে যাব। আর নবমী দশমী মুম্বইয়ে কাটানোর ইচ্ছে আছে।”
মুম্বইয়ের প্রসঙ্গ উঠলই যখন, তখন স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্নটা উঠে আসে যেহেতু তিনি কর্মসূত্রে দীর্ঘ দিন মুম্বইতে কাটিয়েছেন, পুজো দেখেছেন দুই জায়গারই। তা হলে পছন্দের কোনটা? এই বিষয়ে ‘বিনোদিনী’র পরিচালকের সাফ জবাব, “আমি জানি, এই উত্তর পড়ে মানুষ হয়তো আমাকে খুব ট্রোল করবে। কিন্তু তাও বলব, আমার মুম্বইয়ের পুজো ভাল লাগে। কলকাতার পুজোর মধ্যে একটা হই হট্টগোল আছে, ভিড়, খাওয়া-দাওয়া সবই আছে। কলকাতার পুজোর সঙ্গে কারও কোনও তুলনাই করা যায় না। কিন্তু প্রশ্নটা যেহেতু, আমার কোন পুজো ভাল লাগে, কলকাতা না মুম্বই, তাই জবাব মুম্বই হবে।”
কেন মুম্বইয়ের পুজো ভাল লাগে, সেটা ব্যাখ্যা করে রামকমল বলেন, “মুম্বইয়ের পুজো অনেক বেশি সোসাইটির পুজোর মতো, অনেকে মিলে করেন। এই পুজোগুলির বিশেষত্ব হল ৪ দিন এরা খুব সুন্দর ভোগ দেয়, এবং সকলকে সেই ভোগ দেওয়া হয়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে চলা হয়। এ ছাড়া খারের রামকৃষ্ণ মিশনের পুজো খুবই সুন্দর হয়। ওখানে বেলুড় মঠের মতো করেই পুজো হয়, দেখলে মনে হবে যেন কলকাতাতেই আছি। শিবাজী পার্কে যে পুজো হয় সেটা প্রায় কলকাতার পার্ক সার্কাসের পুজোর মতোই যেখানে মেলা বসে, নানা ধরনের খাবার, আচার-সহ সব পাওয়া যায়। পুজোর সময় এখানটা ‘মিনি কলকাতা’ হয়ে ওঠে। ফলে আমি কখনও কলকাতার পুজোকে সেই অর্থে মিস করিনি।” তিনি এ দিন এও জানান, কলকাতার পুজো এখন ভীষণ বাণিজ্যিক হয়ে গেছে। বলেন, “ঠাকুরের মুখটাও ভাল ভাবে দেখতে দেয় না। জলের ব্যবস্থা থাকে না। আমি বড় পুজোর কথাগুলিই মূলত বলছি, মানে ‘শ্রীভূমি’, ‘সিমলা ব্যায়াম সমিতি’, সন্তোষপুরের মতো বড় বড় পুজোর কথা। পুজোটা কলকাতার মানুষ কতটা উপভোগ করতে পারেন সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।”
পুজো মানেই বাঙালির নতুন জামা চাই চাই! পরিচালকেরও কি কেনাকাটা হল? প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলেন ‘লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল’-এর পরিচালক। বলেন, “বাঙালিরা পুজোয় কেনাকাটা করতে পছন্দ করে আমি জানি, কিন্তু আমাদের সারা বছরই কিছু না কিছু কেনাকাটা চলতে থাকে। এই তো সবে গণপতি গেল, তার পর পুজো, তার পরই আবার দীপাবলি। আর তা ছাড়া, আমার জন্মদিন যেহেতু পুজোর আগে আগেই পড়ে সেহেতু তখন থেকেই সবার থেকে উপহার পাওয়া শুরু হয়ে যায়। তবে স্ত্রী, পুত্র, মা, শ্বশুর বাড়ির সকলের জন্য কেনাকাটা করতে হয়। এ ছাড়া কিছু নিয়ম আমি আজও মেনে চলার চেষ্টা করি। যেমন দেবীকে শাড়ি দিয়ে পুজো দিই, অষ্টমীর দিন খুব কাছের গুরুজনদের জামাকাপড় দিই। আমার যাঁরা ভাল বন্ধু, আমার সঙ্গে কাজ করেন, প্রযোজক, অভিনেতা এঁদের উপহার দেওয়া পছন্দ করি এই সময়।” রামকমল জানান তিনি অনলাইন নয়, বরং নিজে গিয়ে দেখে কিনতে পছন্দ করেন। কেনাকাটার প্রসঙ্গ উঠতেই পরিচালকের মনে পড়ে যায় ছোটবেলার কথা। বলেন, “ছোটবেলায় মা, ঠাকুমা, পিসি এঁদের সঙ্গে বেরিয়ে নিউ মার্কেট থেকে গিয়ে ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করাটা খুব মিস্ করি। ওটা খুব ভাল স্মৃতি।”
ছোটবেলার কেনাকাটার প্রসঙ্গ উঠলই যখন ছোটবেলার পুজোর স্মৃতি কি বাদ যায় আর? এই সময় দাঁড়িয়ে অতীতের কোন রঙিন স্মৃতি আজও মনে পড়ে জানতে চাইলে রামকমল বলেন, “ছোটবেলায় একটা বাঁধাধরা ব্যাপার ছিল। সপ্তমী হচ্ছে উত্তরের জন্য, অষ্টমী হচ্ছে দক্ষিণ। আর নবমী সল্টলেকের দিকে যাওয়া হত। সেই মতো বাবা একটা গাড়ি বুক করতেন, তাতে করেই আমরা টইটই করে ঘুরতাম। যে দিন দক্ষিণে যেতাম সে দিন কালীঘাট দর্শন করা হতো, আর উত্তরে গেলে দক্ষিণেশ্বর-বেলুড় মঠে যেতাম। আর ছোটবেলার পুজো বললেই পার্ক সার্কাসের পুজোর কথা মনে পড়ে যায়। ওখানকার প্রতিমার চোখের মধ্যে একটা অদ্ভুত জ্যোতি ছিল। ওখানে একটা বিশাল বড় মেলা বসত, ওটা দারুণ লাগত। ওখান থেকে সাবুর পাঁপড়, ডালিমের হজমিগুলি, আচার তাঁতের শাড়ি, সরু বাঁশকাঠি চালের মুড়ি, নতুন গামছা কিনতেন মা। বাংলাদেশের স্টল বসত, ওখান থেকে ঢাকাই শাড়ি, ইত্যাদি কেনা হত যা উপহার হিসেবে ভাইফোঁটায় বোনেদের দেওয়া হত।” উঠে আসে তাঁর কলেজবেলার কথাও। “কলেজ জীবনে বন্ধুদের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যাওয়ার মজা ছিল। তখন ঠাকুর দেখার পাশাপাশি বন্ধুদের সঙ্গে রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাওয়া হত। এখন তো নানা ধরনের খাবার পাওয়া যায়, সেই সময় নুডুলস আর বিরিয়ানিতেই শেষ হয়ে যেত। আর যেখানে যে খাবার জনপ্রিয় সেখানেই যেতে হত, তখন এত ‘ব্রাঞ্চ’ ছিল না সেই সমস্ত জনপ্রিয় রেস্তোরাঁর। ‘
আচ্ছা পরিচালকের কি কখনও কোনও পুজো প্রেম হয়েছে? শরতে জীবনে কি বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে কখনও? “কলেজ জীবন থেকেই প্রেম ছিল, ফলে আলাদা করে প্যান্ডেলে গিয়ে প্রেম হয়নি। যাকে ভালবাসতাম, যে বন্ধু ছিল, তাকেই বিয়ে করেছি। তার সঙ্গেই পুজোর সময় ঠাকুর দেখতে যেতাম, খেতে যেতাম, সময় কাটাতাম। তাই আলাদা করে অন্য কিছুর সুযোগ হয়নি”, জবাব রামকমলের।
হাল আমলে অনেকেই ঠাকুর দেখার বদলে বাড়ি বসে আড্ডা দেওয়াকেই বেশি প্রাধান্য দেন। ‘বিনোদিনী’র পরিচালক কোন দলে পড়েন? খানিক হেসে তিনি জানালেন, “ছোটোবেলায় ঠাকুর দেখা পছন্দের ছিল। তখন একটা অন্য রকম ‘ভাইব’ ছিল, বাড়ি বসে থাকত ভাল লাগত না। কিন্তু এখন মনে হয় আড্ডাটা বেশি ভাল। আজকাল কলকাতায় পুজোর সময় খুব গরম পড়ে, তার মধ্যে ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখার বদলে ঠান্ডা ঘরে বসে আড্ডা দেওয়া ঘরের খাবার খাওয়া এগুলিই ভাল লাগে। আর বম্বেতে থাকলে আড্ডাটা প্যান্ডেলে বসে। সন্ধ্যাবেলায় আবার সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়, খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বরা পারফর্ম করেন।”
সামনেই ছবি মুক্তি, দেবীর কাছে এ বার কী চাইবেন তিনি? রামকমল জানালেন, “মা দুর্গার কাছে কিছু চাইত হয় না। তাকে তো মা বলি, মায়ের মতো করেই ভালবাসি। আমি মনে মনে বলি ‘তুমি তো সব জানো, আর তো কিছু বলার নেই’। তাই আলাদা করে কিছু চাওয়ার থাকে না। প্রার্থনা বললে, বলি সবাইকে ভাল রাখতে। মনের শান্তি বজায় রাখতে।”
পুজোর পরেই যেহেতু ছবি মুক্তি, তা হলে কি এই সময় জমিয়ে প্রচার করবেন? এই বিষয়ে তাঁর জবাব ‘না’। বরং পুজোর ছবি দেখবেন। রামকমলের কথায়, “পুজোর সময় কোনও প্রচার হবে না। হয়তো কয়েকটা প্যান্ডেলে যেতে পারি। এ বার পুজোয় কয়েকটা ভাল ভাল ছবি আসছে, সেটা ‘রঘু ডাকাত’ বলুন বা ‘দেবী চৌধুরানী’ বা ‘রক্তবীজ’। এদের তখন প্রচার চলবে, তার মধ্যে ঢুকে আমাদের প্রচার করার অর্থ নেই। তবে পুজোয় আমি ‘রঘু ডাকাত’ দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি। সব ছবিই দেখব, তবে সবার আগে ‘রঘু ডাকাত’ দেখব। দেব আমার খুব পছন্দের, কাছের মানুষ।”
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।