প্রেজেন্টস্
Knowledge Partner
Fashion Partner
Wedding Partner
Banking Partner
Comfort Partner

হাটখোলা দত্ত পরিবারের পুজোতেও ছাপ ফেলেছিল দেশপ্রেম

১৭৯৪ সালে এই বাড়িতে যে পুজো শুরু হয়েছিল সেই পুজো আজও চলছে একই রকম নিষ্ঠা আর ভালবাসায়।

সায়ন্তনী সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৮ ১৬:৩৭
হাটখোলা দত্তবাড়ির প্রতিমা।

হাটখোলা দত্তবাড়ির প্রতিমা।

সে বহু বছর আগের কথা। নিমতলা স্ট্রিটে বিরাট এক অট্টালিকা তৈরির কাজ চলছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান জগৎরাম দত্ত বড় যত্নে বানাচ্ছেন বাড়িটি। আদতে কনৌজের বাসিন্দা এই পরিবার কনৌজ ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছেন বহুকাল আগে। সুতানুটি কলকাতার সঙ্গে যে গোবিন্দপুরের নাম উচ্চারিত হয়, জগৎরামের পূর্বপুরুষ গোবিন্দশরণ দত্তর নামেই সেই গোবিন্দপুরের নাম। গোবিন্দপুরেও অবশ্য থিতু হয়নি পুরো পরিবার। দত্ত পরিবার ভাগ হয়েছে কখনও আন্দুল কখনও হাটখোলায়। এ বার নিমতলা স্ট্রিটে বাড়িটি তৈরি করে এখানে দুর্গাপুজো শুরু করবেন, এমনটাই ইচ্ছে জগৎরাম দত্তের। ঠাকুরদালান তৈরি করতে গিয়ে তাঁর মনে হল, সব তীর্থস্থানের পবিত্র মাটি দিয়ে যদি এই দালান তৈরি করা যায় তা হলে কেমন হয়? যেমন ভাবা তেমন কাজ। তখন না ছিল ট্রেন, না ছিল সড়কপথে ভাল যোগাযোগ ব্যবস্থা। নৌকাই যাতায়াতের একমাত্র উপায়। দ্বারকা, পুরী, কাশী, হরিদ্বার থেকে নৌকা বোঝাই করে তীর্থের মাটি আসতে লাগল গঙ্গার ঘাটে। সেই মাটি দিয়ে তৈরি হল উঠোন, ঠাকুরদালান। কালের প্রকোপে ঠাকুরদালান নষ্ট হয়ে গেলেও আজও সেই উঠোন আছে হাটখোলা দত্ত বাড়িতে।

১৭৯৪ সালে এই বাড়িতে যে পুজো শুরু হয়েছিল সেই পুজো আজও চলছে একই রকম নিষ্ঠা আর ভালবাসায়। উল্টোরথের দিন কাঠামো পুজো হয়। শ্রাবণ মাসেই শুরু হয়ে যায় প্রতিমা তৈরির কাজ। এই বাড়ির প্রতিমা তৈরি হয় মঠচৌড়ি পদ্ধতিতে। ঠাকুরকে কোনও পোশাক পরানো হয় না। দক্ষ হাতে মাটির উপর রং-তুলি দিয়ে দেবীর পোশাক আঁকেন শিল্পী। দত্ত বাড়িতে এত দিন পর্যন্ত পুজো উৎসর্গ হত কুলগুরুর নামে। বাড়ির কোনও সদস্যের নামে পুজো হত না। কুলগুরুই পুজো পরিচালনা করতেন। কে কোন কাজ করবেন বা কার পুজোতে কী দায়িত্ব, সবই নির্ধারণ করতেন তিনি। অব্রাহ্মণ হওয়ায় দত্ত পরিবারের কোনও সদস্য পুজোর কাজ করতে পারতেন না। এখন অবশ্য আর সে নিয়ম নেই। বাড়ির কোনও সদস্যের নামেই পুজো উৎসর্গ হয়। আগে বোধনের সময় থেকে পুজো পর্যন্ত বারো জন স্মৃতিতীর্থ পণ্ডিত দুর্গা নাম এবং চণ্ডী নাম জপ করতেন। এখন পণ্ডিতের সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে।

ষষ্ঠীর দিন বেল বরণের মাধ্যমে ঠাকুরকে আবাহন করা হয়। বেলগাছের নীচে বাড়ির কুলদেবতা শালগ্রাম শিলাকে নিয়ে আসা হয়। দত্ত বাড়িতে শুধু বেল বরণের সময়েই কুলদেবতা নীচে নামেন। অন্যান্য বনেদি বাড়ির মতো পুজোর সময় তিনি ঠাকুরদালানে উপস্থিত থাকেন না। পুজোবাড়ির লোকের নাম উৎসর্গ হয় না বলে নবমী ছাড়া পুজোর বাকি দিনগুলিতে অঞ্জলি দেন না বাড়ির লোক। এমনকি, অষ্টমীর অঞ্জলিও দিতে পারেন না তাঁরা। নবমীতে দক্ষিণান্ত হয়ে যাওয়ার পর অঞ্জলি দেন পরিবারের সবাই। অষ্টমীতে ক্ষীরের পুতুল বলি দেওয়া হয় হাটখোলা দত্ত বাড়িতে। যদিও বাড়ির লোকেদের বলি দেখার অধিকার নেই। বলির জায়গাটা কাপড় দিয়ে ঘিরে বলি দেওয়া হয়। এই বাড়িতে সিদুঁর খেলার নিয়ম ছিল না। অষ্টমীর দিন সন্ধিপুজোর পর মায়ের সিঁদুর নিয়ে বিবাহিতরা একে অপরকে পরিয়ে দেন।

আরও পড়ুন: লাহা পরিবারের পুজো​

দত্ত বাড়িতে ভোগের সামগ্রী তৈরি হয় ঘি দিয়ে। পুজো শুরুর সময় থেকে একই জিনিস দিয়ে আসা হচ্ছে ঠাকুরকে। আগে পুজোর সপ্তাহখানেক আগে থেকেই বিরাট বিরাট উনুন জ্বালিয়ে সারা দিন-রাত ধরে তৈরি হত মিষ্টি আর নোনতা। সেই সময় বিরাট পরিবার ছিল। বাইরে থেকেও আসতেন সবাই। এখন সদস্য অনেক কম, তাই চতুর্থীর দিন ভিয়েন বসে। জিলিপি নিমকি খাজা দরবেশের মতো প্রচলিত মিষ্টির সঙ্গে তৈরি হয় লালমোহন, মুটরি, অর্থাৎ ময়দা, ঘি দিয়ে তৈরি বরফির মতো এক রকম জিনিস, নারকেলের পুর দেওয়া পেরাকি, পোলাও নামে অনেকটা দরবেশের মতো দেখতে সাদা রংয়ের এক রকম মিষ্টি , গোলমরিচ দেওয়া মতিচূড়। এই বাড়িতে পুরনো দিন থেকেই শিঙারার মতো দেখতে, কিন্তু আলু ছাড়া এক রকম নোনতা তৈরি হয় একে বলে ‘সমোসা’, পোস্ত দিয়ে তৈরি মিঠে গজা। এ সব ছাড়াও ঠাকুরকে লুচি এবং বাটা চিনি ‘নিজ ভোগ’, অর্থাৎ ঠাকুরের জন্য নির্দিষ্ট বিশেষ ভোগ দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন: আটটি বাড়িতে পুজো হয় সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের​

ব্যবসা থেকে উপার্জন যতই হোক না কেন, জমিদারদের মানসম্মান সেই সময় ব্যবসায়ীদের থেকে বেশি ছিল। এই কারণেই সম্ভবত ব্যবসায় ধনলাভের সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর জমিজমা কিনতেন ব্যবসায়ীরা। দত্তরাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। জাহাজের মাল কেনাবেচা সংক্রান্ত এবং আনুষঙ্গিক ব্যবসায় অর্থলাভ করার পর খুলনা, কলকাতায় প্রচুর জমিজমা কেনেন তাঁরা। কিন্তু সেই সময়ে বাবু কালচারের যে ধারা ছিল তা এই পরিবারে অনুপস্থিত ছিল। শুধু তাই নয়, রমেশচন্দ্র দত্ত, তরু দত্ত, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মা প্রভাবতী বসু-সহ বহু কৃতী মানুষ এই পরিবারের সদস্য ছিলেন। তৎকালীন অন্য বনেদি পরিবারগুলি যখন বুলবুলির লড়াই আর বাঈজি বিলাসে সময় এবং অর্থব্যয় করছে তখন দত্ত পরিবারের মধ্যে অঙ্কুরিত হচ্ছে দেশপ্রেম। পরে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে এই বাড়ির সদস্যরাও অরন্ধন পালন করে একে অপরকে রাখি পরিয়ে দেন। একসময় পুজোতেও ছাপ ফেলল সেই চিন্তাধারা। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘বঙ্গ আমার জননী আমার ধাত্রী আমার আমার দেশ’ গানটি সেই সময় অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। গানটি রচনার পরের বছর থেকে দশমীর দিন ঠাকুর বিসর্জনের পর উদাত্ত কণ্ঠে গানটি গাইতে গাইতে গঙ্গার ঘাট থেকে ফিরতেন দত্ত পরিবারের সদস্যরা। সেই প্রথা আজও চলছে। এখনও দত্ত পরিবারের সদস্যরা ঠাকুর বিসর্জন দিয়ে এই গানটি গাইতে গাইতে বাড়ি ফেরেন।

ছবি: অভীক দত্ত।

Durga Puja Preparations Kolkata Bonedi Bari Bonedi Barir Durga Puja Aristocratic Family Durga Puja
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy