Advertisement
বাগবাজার হালদার বাড়ির পুজো
Durga Puja Preparations

ষষ্ঠীর দিন আমিষ খেতেই হয় হালদার বাড়ির মেয়েদের

হালদার বাড়িতে শুধুমাত্র কষ্ঠিপাথরের মূর্তিটিই পূজিত হয়।

হালদার বাড়ির পুজো বরাবরই আলাদা।

হালদার বাড়ির পুজো বরাবরই আলাদা।

সায়ন্তনী সেনগুপ্ত
শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৮ ১১:২০
Share: Save:

বাগবাজার হালদার বাড়ির পুজো শহরের অন্যান্য বনেদি বাড়ির পুজোগুলির থেকে অনেকটাই আলাদা। এখানে দেবীমূর্তি কষ্ঠিপাথরের। মা এই বাড়ির গৃহদেবতা হিসেবে নিত্য পূজিত হন।দুর্গাপুজোর দিনগুলিতে একটু আলাদাভাবে বিধি মেনে পুজো করা হয় মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তির। বহু প্রাচীন এই মাতৃমূর্তিতে দুর্গার দু’পাশে একটু নীচের দিকে রয়েছেন তাঁর দুই সখী জয়া আর বিজয়া। মাথার উপরে রয়েছে মহাকাল। সালঙ্কারা দুর্গা পদ্মের উপর আসীন। এই মূর্তি নাকি বহুবছর আগে ওড়িশার কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছিল।

এই পরিবারের সদস্য দেবাশিস হালদারের কথায়, হালদার পরিবারের এক পূর্বপুরুষ একবার বালেশ্বরের কাছে সাহেবপুরে বেড়াতে যান। সেখানে স্বপ্নাদেশে দেবী তাঁকে বলেন যে ওই অঞ্চলে এক মুসলমান জেলে পরিবারের বাড়ির নীচে মাটির ১৪ ফুট গভীরে তাঁকে উল্টো করে শায়িত রাখা আছে। সেখান থেকে তুলে নিয়ে এসে তাঁকে যেন নিত্যপুজো করা হয়। সেই ব্যক্তি তৎক্ষণাৎ ওই অঞ্চলে খনন করে আড়াই ফুটের এই মূর্তি উদ্ধার করেন। সম্ভবত বঙ্গে মুসলমান আক্রমণের সময়ে কোনও ভক্ত দেবীকে মাটির তলায় সুরক্ষিত রেখেছিলেন।সেই থেকে তিনি হালদার পরিবারে পূজিতা। এই পরিবারের আর এক পুরুষ প্রাণকৃষ্ণ হালদারের সময়ে অর্থ এবং প্রতিপত্তি দুইই রীতিমতো বৃদ্ধি পায়। বেঙ্গল গেজেট, সমাচার দর্পণ সমেতসেই সময়ের কিছু নামী কাগজে প্রাণকৃষ্ণ হালদারকে ‘বাবুদের বাবু’ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। ইংরেজদের সঙ্গে যথেষ্ট হৃদ্যতা থাকায় তিনি প্রতি পুজোয় তাঁদের আমন্ত্রণ করতেন। কিন্তু নিজের জাঁকজমক এবং ঐশ্বর্য দেখানোর জন্য দেবীর মাটির মূর্তি পুজো করতেন। সেই সঙ্গে ঠাকুরের পাশে এই মূর্তিও পূজিত হতেন।

সময় বদলেছে। এখন এই বাড়িতে শুধুমাত্র কষ্ঠিপাথরের মূর্তিটিই পূজিত হয়। পুজোর সময় বাড়ির নিয়ম অনুসারে দেবীকে দক্ষিণমুখী করে দেওয়া হয়। মনে করা হয়, উত্তরের কৈলাশ থেকে দক্ষিণে মুখ করে দেবীর মর্ত্যে আগমন ঘটল। পঞ্চমীর দিন দেবীর বোধন হয়। এরপর অনুষ্ঠিত হয় আমন্ত্রণ এবং অধিবাস। ষষ্ঠীর দিন ঢাকিরা আসেন। এই বাড়ির মহিলারা দুর্গাষষ্ঠী পালন করেন না। আমিষ এইদিন খেতেই হয় মেয়েদের। মাছ খেয়ে পান মুখে দিয়ে প্রথমে জলের ফোঁটা দিয়ে ঢাক বরণ করেন তাঁরা। পুজোর যাবতীয় কাজ সেদিন আমিষ খেয়েই করতে হয় ওই দিন।

আরও পড়ুন: সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, তিনদিনই কুমারী পুজো হয় এখানে

এই বাড়ির নবপত্রিকা স্নান একটু অন্যরকম। হালদারদের দুই জ্ঞাতি পরিবারের নবপত্রিকা এদিন একসঙ্গে স্নানে যায় বিরাট বিরাট দুই ছাতার তলায়। অত্যন্ত গোঁড়া পরিবার হলেও পুজো শুরুর সময় থেকেই বাড়ির সব মেয়েদের গঙ্গার ঘাটে এই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে যেতে হত। এখনও সেই নিয়ম চলছে। বোধনের দিন রেড়ির তেলে যে ‘জাগ প্রদীপ’ জ্বালানো হয় তা বিসর্জন পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্যও নেভানো হয় না। হালদার বাড়ির কষ্ঠিপাথরের দুর্গা অত্যন্ত জাগ্রত বলে মনে করেন সবাই। তাঁরা বিশ্বাস করেন জাগ প্রদীপ নিভে যাওয়া অশুভ। ঠাকুরের পুজো সমাপ্ত হয়ে গেলে এই প্রদীপে আর তেল দেওয়া হয় না, আস্তে আস্তে নিভে যায় প্রদীপ। কিন্তু কখনওই নিজে থেকে বাড়ির সদস্যরা প্রদীপ নেভান না।

অষ্টমীর দিন সন্ধিপুজোয় যে ১০৮ প্রদীপ দেওয়া হয় সেটিও বড় সুন্দর করে সাজানো হয়। কখনও ত্রিশূল, কখনও প্রজাপতি, কখনও দেবীর ত্রিনয়ন বা আবার কল্পতরু গাছের মত চেহারা দেওয়া হয় প্রদীপগুলির। এই প্রদীপগুলিকে কলাপাতার উপর রাখা হয়, তারপর সেগুলি জুড়ে দেওয়া হয় পরস্পরের সঙ্গে। তবে সন্ধিপুজোর কোনও কাজ মহিলারা করতে পারেন না। এই কাজ করতে হয় পুরুষদেরই। কাটা ফল নয়, সন্ধিপুজোর সময় বড় বড় আস্ত ফলে পুজো করাটা এ বাড়ির নিয়ম। বিরাট বড় একটা আখ থাকতেই হয় এই ফলের মধ্যে। এছাড়াও পুজোর উপকরণে থাকে মেওয়া ও চাল। নবমীর দিন কুমারীপুজো হয় ধুমধাম করে। পুজো শেষে বাড়ির ছেলেরা কোলে করে কুমারীকে নিয়ে যান গৌড়ীয় মঠে। সেখানেতাঁকে তিনবার ঘুরিয়ে তবে মটিতে নামানো হয়। দশমীর দিনঢাক বিসর্জন হয় এই বাড়িতে। সেই সময় বাড়ির এয়োরা মাছ খেয়ে পান খেয়ে হলুদ জলে ভেজানো কড়ি দিয়ে ঢাক বরণ করেন। সেই সঙ্গে ঢাকিকে ফলমূল, মিষ্টি, কাপড় দেওয়া হয়। ঢাক বিসর্জন হয়ে গেলে ঢাকে ফের কাঠি দেওয়া নিষেধ।

এই বাড়িতে দেবীকে অন্নভোগ দেওয়া হয়। পঞ্চমী থেকে বাড়িতে নাড়ু তৈরি হয়। ষষ্ঠীর দিন ‘ঘি ভাত’ দেওয়া হয় দেবীকে। এর মধ্যে থাকে আলু পটল ফুলকপি, নানারকম তরকারি। এর সঙ্গে দেওয়া হয় পাঁচ ভাজা। ভাজার মধ্যে মাখন শিম অবশ্যই থাকতে হবে। আর থাকে পায়েস। সকালবেলা কোনও তরকারি দেবীকে ভোগে দেওয়া হয় না। সপ্তমী অষ্টমী নবমী দেবীকে খিচুড়ি ভোগ দেওয়া হয়। এই বাড়িতে চাল ডাল পায়েসের দুধ সব কিছুর মাপ থাকে পাঁচ পো। প্রাচীনকাল থেকে এই নিয়ম পালন করা হয়। মাপের একচুল এদিক-ওদিক হলে সেই ভোগ আর দেবীকে দেওয়ায় যোগ্য বলে বিবেচিত হয় না।

আরও পড়ুন: শরতের এই-মেঘ এই-বৃষ্টির মতো প্যান্ডেলের পারিজাতকে ভাল লাগার শুরু​

এর সঙ্গে দেবীকে মাটির মালসায় দেওয়া হয় সরবত। বাটাচিনি আর লেবু দিয়ে এই সরবত তৈরি করা হয়। সন্ধ্যাবেলা দেবীর ভোগে লুচি, তিনরকম তরকারি, চাটনি, পায়েস, বাটা চিনি ভোগ দেওয়া হয়। দশমীর দিন এখানে মাছ রান্না হয়। মাছ-ভাত খেয়ে মুখে পান দিয়ে তবেই মেয়েরা ঢাক বিসর্জন করতে পারেন।

ছবি সৌজন্য: ডাঃ পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE