প্রেজেন্টস্
Knowledge Partner
Fashion Partner
Wedding Partner
Banking Partner
Comfort Partner

পুজোয়ে প্রামাণিক বাড়ির ঠাকুরদালানের সামনে বসত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর

পুজোর চার দিন সন্ধ্যাবেলা ঠাকুরদালানের সামনে বসত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর

সায়ন্তনী সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৯:২৫

সপ্তগ্রামের পতনের পর যখন হুগলি এবং তারপর কলকাতাকে কেন্দ্র করে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু হচ্ছে, তখন বেশ কিছু বিত্তশালী পরিবার এসে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন ব্যবসার সুবিধার জন্য। হুগলির সাহাগঞ্জ থেকে মদনমোহন প্রামাণিকও পরিবার-সহ এই সময় কলকাতায় চলে আসেন। মদনমোহনের বাসন নির্মাণের কারখানা ছিল।

তাঁর হঠাৎ ধনী হওয়া নিয়ে নানা অলৌকিক গল্প প্রচলিত আছে। বলা হয়, এক সাধুর আশীর্বাদে নাকি তাঁর কারখানার সমস্ত ধাতু রাতারাতি সোনায় পরিণত হয়। মদনমোহনের ছেলে গুরুচরণ তাঁর ব্যবসাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান। তিনি হাওড়ার কাছে ক্যালিডোনিয়া নামে জাহাজ মেরামতির একটি ডক প্রতিষ্ঠা করেন। তখনও বাষ্পীয় জাহাজের খুব একটা চল ছিল না। জাহাজের নীচে তামা অথবা পিতলের আবরণ ব্যবহার করা হত। দীর্ঘ যাত্রার পর এই আবরণগুলি পরিবর্তন করার প্রয়োজন হত। গুরুচরণের ডকে এই কাজগুলি হত বলে খুব অল্প দিনেই তিনি প্রচুর টাকা রোজগার করেছিলেন। প্রামাণিক পরিবারের সব থেকে নামী এবং সফল ব্যক্তি ছিলেন তারক প্রামাণিক। হাওড়ার কাছের ক্যালিডোনিয়া ডকটিকে তিনি রবার্ট প্রামাণিক নামকরণ করেন। জাহাজের নীচের আবরণ পরীক্ষা করার সময় বহু পিতল ও তামার পেরেক মাটিতে পড়ত। সেই মাটিও বিক্রি হত চড়া দামে। এর পর তিনি ইংল্যান্ডে তামা-পিতলের চাদর রফতানি করতে শুরু করলেন। এই কাজ করার জন্য তাঁকে দু’টি জাহাজও কিনতে হয়। রেলে তখন যে কাঠের স্লিপার ব্যবহার হত, সেই স্লিপার তৈরির কাঠ সরবরাহের কাজও এই সময় শুরু করেন তিনি। কিছু দিনের মধ্যেই ব্যবসা থেকে তাঁর বাৎসরিক আয় দাঁড়ায় লক্ষাধিক টাকা। গুরুচরণের সময়েই বিধান সরণির কাছে কলকাতার বাড়িতে প্রামাণিকদের সাবেক দুর্গাপুজা শুরু হয়ে যায়। তারক প্রামাণিক সে পুজোরও শ্রীবৃদ্ধি করেন।

হাজার ঝাড়বাতিতে মোড়া বিরাট বাড়িটা সারা বছর বড় ম্লান হয়ে থাকে। আগে পুজোর সময় আত্মীয়স্বজন চলে আসতেন গাঁ-গঞ্জ থেকে। বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে হাতে হাতে পুজোর সব কাজ করে দিতেন তাঁরাই। এখন কে কোথায় চলে গিয়েছেন। বাড়ি আর ভরে ওঠে না আগের মতো। তাও পুজোর কয়েকটা দিন বেলজিয়াম গ্লাসের বিরাট বিরাট আয়নাগুলি থেকে ঝাড়বাতির আলো ঠিকরে পড়ে। আধুনিক ধাঁচের ঠাকুরদালান আর একলা বাড়িটা সেই আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে। প্রামাণিক বাড়িতে পুজোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় বেশ কিছু দিন আগে থেকেই। বাড়ির মহিলারা অর্ঘ্য প্রস্তুত করেন দেবীর জন্য। ১০৮টি দূর্বা আর ১০৮টি ধানের শিষ থেকে চাল বের করে তাকে আলতা পাতায় মুড়িয়ে লাল সুতো দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। পুজোর সময় সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এবং সন্ধিপুজোয় লাগে এগুলি। বাড়িতেই তৈরি করা হয় পঞ্চগুঁড়ি। সাদা রং তৈরি হয় চালগুঁড়ো দিয়ে, লাল রং তৈরি হয় চালগুঁড়োর সঙ্গে সিঁদুর মিশিয়ে। বাড়িতে বেশ কিছু দিন আগে থেকে বেলপাতা শুকিয়ে রাখা হয়। সবুজ রং তৈরি হয় বেলপাতা গুঁড়ো দিয়ে। কালো রং তৈরি করা হয় কাঠকয়লা গুঁড়ো দিয়ে। আর হলুদ রং করতে ব্যবহার করা হয় হলুদগুঁড়ো।

আরও পড়ুন: দত্তবাড়ির পুজোর সুরে মিশে থাকে দেশাত্মবোধের আবেগ

প্রামাণিক বাড়ির দেবী থাকেন একচালায়। উজ্জ্বল মাতৃমূর্তিতে থাকে মাটির সাজ। এই বাড়িতে ঠাকুরের মূর্তির মধ্যে মহিষ থাকে না। মহালয়ার পর দিন, অর্থাৎ প্রতিপদ থেকে বোধন শুরু হয়ে যায়। তখন থেকে শুরু হয় চণ্ডীপাঠও। ষষ্ঠী পর্যন্ত বোধন ঘরেই পুজো হয়। ষষ্ঠীর দিন থেকে ঠাকুরদালানে পুজো শুরু করা হয়। প্রতিপদে বাড়ির কূলদেবতা শ্রীধরকে নীচে নামানো হয়। সপ্তমীর দিন সকালে কুললক্ষ্মী ধান্যলক্ষ্মীকে ঠাকুরদালানে নিয়ে আসা হয়। বিজয়া দশমীর সুতো কাটার আগে এঁদেরকে আবার ওপরে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

সপ্তমীর সকালে নবপত্রিকার স্নান হয় বাড়িতেই সপ্ততীর্থের জল দিয়ে। কলাবউ স্নানের জন্য বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় না। প্রামাণিক বাড়িতে দেবীর অন্নভোগ হয় না। ঠাকুরকে চালের নৈবেদ্য, ডালের নৈবেদ্য, নানা রকম মিষ্টি আর ফল দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে থাকে কাজু, মেওয়া, নারকেলের মন্ডা। সপ্তমীর সন্ধ্যাবেলা কার্তিক ঠাকুরের জন্য আলাদা তেরোটি ঘট হয়। তাতে পানসুপারি এবং কলা দেওয়া হয়। অষ্টমীর দিন চালের নৈবেদ্য সাজিয়ে দেওয়া হয়। এতে কয়েক মন চালের সঙ্গে থাকে কাটা আখ, গোটা ফল ও পানের খিলি। এ ছাড়াও দেওয়া হয় চিনির জল, মৌরি-মিছরির শরবত। সন্ধিপুজোর সময় ঠাকুরকে তামা ও পিতলের নানা জিনিস দেওয়া হয়। এর মধ্যে থাকে প্রদীপ, প্রদীপদান, কলসি, পানের ডিবা। বৈষ্ণববাড়ি বলে এই বাড়িতে কোনও দিনই বলি দেওয়া হত না। সন্ধিপুজোর সময় ঠাকুরদালানের দুই প্রান্ত জুড়ে প্রদীপ জ্বালানো হয়। দশমীর দিন বিশেষ পান তৈরি হয় দেবীবরণের জন্য। এ দিন প্রচুর পান কাটা হয়। শিরাগুলি রেখে পাতার অংশটি কেটে ফেলা হয়। প্রত্যেকটির ডগায় একটি ছোট খিলি বানানো হয়। বরণের সময় দেবদেবী, অসুর এবং তাঁদের বাহনকে এই পানগুলি দেওয়া হয়। দশমীর বিসর্জন হয় জগন্নাথ ঘাটে।

আরও পড়ুন: প্রাচীন এই পুজোয় কুমারীদেরও হাতে পরতে হয় শাঁখা!

আগে পুজোর চার দিন সন্ধ্যাবেলা ঠাকুরদালানের সামনে বসত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর। সুর ঘুরে বেড়াত বাড়ির প্রতিটি কোণায়। পুরুষরা নীচে বসতেন আর মহিলারা ঠাকুরদালানের সামনে দোতলার জানালায় ফেলে দেওয়া চিকের আড়াল থেকে গান শুনতেন। এখন সেই দিন আর নেই। ভাঙা গ্রামোফোনটাও আর বাজে না এখন। বিদায়বেলায় বাড়ির সবটুকু কোলাহল নিয়ে যে দিন দেবী চলে যান, সেই দিন থেকেই বাড়িটা শুরু করে দিন গোনা। অপেক্ষা শুরু হয় আগামী পুজোর।

Durga Utsav 2019 Ananda Utsav 2019 Durga Puja Celebration
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy