Advertisement
Durga Puja 2020

পুজো শেষে দেবীর মুকুট পরানো হয় বেতাইচণ্ডীকে

রায়চৌধুরী পরিবারের আদি নিবাস ছিল চাণকে, যা বর্তমানে উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুর।

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য
শিবপুর রায়চৌধুরীবাড়ি (সাঁঝের আটচালা) শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২০ ০৫:৩০
Share: Save:

দেশে তখন মুঘল শাসন,দিল্লির মসনদে বাদশা আলমগির।প্রাচীন হাওড়ার শিবপুর অঞ্চলে বহু দিনের বাসিন্দাবেতাইচণ্ডীর উপাসক রায়চৌধুরী পরিবারে সে সময়ে অন্যতম প্রধান রাজা রামব্রহ্ম রায়চৌধুরী। কয়েক দিন ধরে রামব্রহ্ম পড়েছেন এক সমস্যায়।তাঁর শিশুকন্যাটিকে নিয়ে তিনি বড়ই চিন্তিত। প্রতিদিন দুপুর গড়ালেই সে পুকুরপাড়ে খেলতে চলে যায়।কোনও ভাবেই তাকে ধরে রাখা যায় না। অথচ পুকুরপাড়ে তাকে ছাড়া আর কাউকেই দেখা যায় না। তবে কার সঙ্গে খেলা করে সে?এই নিয়ে পরিবারের সকলেই বেশ উদ্বিঘ্ন।

একদিন রামব্রহ্ম তাঁর মেয়েকে সস্নেহে জিজ্ঞেস করলেন,প্রতিদিন পুকুরধাটে সে কী করে। এর উত্তরে মেয়েটি বলল, সে তার বন্ধু পদ্মাবতীর সঙ্গে খেলা করে। এর পরে রামব্রহ্ম মেয়ের অন্য বন্ধুদের কাছে খোঁজ নিলেন পদ্মাবতী নামে তাদেরকোনও সমবয়সী আছে কি না। সকলেই জানাল পদ্মাবতী নামে তারা কাউকে চেনে না।এতে রামব্রহ্মের দুশ্চিন্তা গেল আরও বেড়ে।

এ বাররামব্রহ্ম তাঁর মেয়েকে বললেন,সে দিনই পদ্মাবতীকে তাঁর কাছে নিয়ে আসতে। মেয়েটি পদ্মাবতীকে সে কথা জানাতেই পদ্মাবতী বলল, নিজের ইচ্ছে ছাড়া কারও কথায় কোথাও সে যায় না। রামব্রহ্মকেমেয়ে এ কথা জানাতে তাঁর আত্মসম্মানে আঘাত লাগল।তখনইমেয়েকে নিয়ে সেই পুকুরঘাটে উপস্থিত হলেন।কার এমন স্পর্ধা তাকে দেখার জন্য। কিন্তু কোথায় পদ্মাবতী? পুকুরপাড়ে তখন দেখা গেল ছোট ছোট কয়েকটি পায়ের ছাপ, যা জলে মিলিয়ে গিয়েছে। রামব্রহ্ম অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে মেয়েকে বললেন আর পদ্মাবতীর সঙ্গে না মিশতে। মনে মনে ভাবলেন, পদ্মাবতী হয়তো ভয় পেয়ে পুকুর সাঁতরে ওপারে পালিয়েছে।

আরও পড়ুন: পুজো শেষে দেবীর মুকুট পরানো হয় বেতাইচণ্ডীকে

তিনটি দালান যুক্ত পাঁচ খিলানের দালানে দেবীর অধিষ্ঠান।

সেই রাতেই রামব্রহ্ম স্বপ্নাদেশে পেলেন। জানতে পারলেন, পদ্মাবতীই দেবী দুর্গা এবং তিনি তাঁর কাছে পুজো চান। রামব্রহ্ম দেবীকে জানালেন, তিনি বেতাইচণ্ডীর উপাসক। তাই অন্য দেবীর পুজো করবেন কী করে? দেবী বললেন- যিনি দুর্গা, তিনিই চণ্ডী।এর পর রামব্রহ্ম দেবীকে জিজ্ঞাসা করলেন তাঁর পুজো হবে কী করে? কারণ দেবীই তো তাঁর মেয়েকে বলেছেন যে তিনি নিজের ইচ্ছে ছাড়া কারও কথায় কোথাও যান না। দেবী তখন বলেছিলেন, যত দিন তাঁর বংশধরেরা মনেপ্রাণে তাঁকে ডাকবে, ততদিন তিনি এই পরিবারে পুজো গ্রহণ করবেন।সেই থেকেই পুজোর সূচনা রায়চৌধুরী পরিবারে। আর ভক্তিতে, বিশ্বাসে আজও অটুটসেই পুজোর ঐতিহ্য।

ভরদ্বাজ গোত্রীয় ব্রাহ্মণ এই পরিবারের পদবি আসলে মুখোপাধ্যায়। বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খানের আমলে এই পরিবার রায়চৌধুরী খেতাব লাভ করে। পরিবারের আদি নিবাস ছিল চাণকে, যা বর্তমানে উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুর। পরিবারের অন্যতম প্রবীণ সদস্য এবং প্রাক্তন এমআইসি অরুণ রায়চৌধুরী স্মৃতি হাতড়ে বলছিলেন- ১৬৮৫-৮৬ সাল নাগাদ শুরু হয় এই পুজো।তিনটি দালান যুক্ত পাঁচ খিলানের দালানে দেবীর অধিষ্ঠান। সাবেক বাংলা রীতির প্রতিমার গায়ে কৃষ্ণনগরের ঝলমলে ঢাকের সাজ শোভা পায়। অতীতের সেই পুকুরটি আজও আছে। তার নাম বেলেপুকুর। বৃহন্নন্দীকেশ্বর পুরাণ মতে এখানে পুজো হয় কৃষ্ণনবম্যাদিকল্বে। বোধন হয় মহালয়ার আগে নবমীতে। অতীতে বোধনের দিনশাস্ত্রজ্ঞব্রাহ্মণরা এসে প্রতিমা দেখে নির্ণয় করতেন, তা শাস্ত্র সম্মত হয়েছে কিনা।এর পরেই শুরু হত প্রতিমা রং করার কাজ। ঠাকুরদালান সংলগ্ন চণ্ডীর ঘর।সেখানে রয়েছে বহু প্রাচীন একটি বোধনের বেলগাছ।কৃষ্ণপক্ষের নবমী থেকে শুক্লপক্ষের নবমী পর্যন্তসেখানেই চলে চণ্ডীপাঠ। এই পরিবারের পুজোয় কিছু ব্যতিক্রমীআচার ও রীতি দেখা যায়। যেমন, প্রতিমার সামনে কোনও ঘটস্থাপন করা হয় না। দেবীর মূলঘটটি স্থাপন করা হয় বোধনের ঘরে।

বোধন হয় মহালয়ার আগে নবমীতে।

এই পুজোয় আজও হয় পশুবলি। সপ্তমীতে একটি, অষ্টমীতে দু’টি এবং নবমীতে একটি পাঁঠাবলি হয়। নবমীর দিন বেতাইচণ্ডীর উদ্দেশেও একটি পাঁঠাবলি দেওয়া হয়। বোধনের দিন থেকে প্রতিদিন হয় অন্নভোগ। সপ্তমী থেকে নবমী ভোগে থাকে খিচুড়ি, সাদা ভাত, ভাজা, নানা ধরনের ডালনা, তরকারি, চচ্চড়ি। এ ছাড়াও থাকে মাছের নানা পদ,চালতার চাটনি এবং পায়েস। দশমীতে থাকে পান্তা ভোগ।

দশমীর সন্ধ্যায় গঙ্গায় প্রতিমা নিরঞ্জনের আগে দুর্গাপ্রতিমার মুকুটটি খুলে রাখা হয়। বিসর্জন শেষে বাড়ির পুরোহিত সেই মুকুটটি নিয়ে বেতাইচণ্ডীর মন্দিরে যান। বেতাইচণ্ডীকে সেই মুকুটটি পরিয়ে বিশেষ পুজো সেরে পুরোহিত বেতাইচণ্ডীর পুরনো মুকুটটি রায়চৌধুরী বাড়িতে নিয়ে আসেন। এর পরে পুরোহিত পরিবারের সদস্যদের শান্তির জল দেন।

আরও পড়ুন: ঐতিহ্য আর আভিজাত্যে ইতিহাস বয়ে চলছে শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো পদ্ধতি

পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও পুজোয় মিলিত হন দূরে বসবাসকারী আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব। কয়েকটা দিন জীবনের সব অপ্রাপ্তি ভুলে এক অনাবিল আনন্দে মেতে ওঠেন সকলে। তবে এ বার ছবিটা ভিন্ন। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে এ বার করোনা আবহে ঠাকুরদালানে সামাজিক দূরত্ব বিধি মেনে পুজোর আচার অনুষ্ঠান পালন করা হবে।

ছবি: পরিবার সূত্রে পাওয়া।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE